আমেরিকা-ইউরোপসহ সমগ্র পৃথিবী জুড়ে করোনা টিকা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরিবহন, বিপণন ও প্রয়োগের প্রস্তুতি চলছে বেশ জোরেশোরে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটুকু? পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশের করোনা টিকা প্রাপ্তি, সংরক্ষণ, পরিবহন, বিপণন ও প্রয়োগের প্রস্তুতি নিয়ে দৃশ্যমান কোন ধরনের তোড়জোড় পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এমন কি বাংলাদেশ টিকা কুটনীতিতেও অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত।
বাংলাদেশ শুধুমাত্র অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে কার্যত কোভিড টিকা সংগ্রহ কমসূচী হাতে নিয়ে এগুচ্ছে। কিন্তু অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকাটির সাম্প্রতিক পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় কখন অনুমোদন পেতে পারে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কবে নাগাদ টিকাটি মানুষ ব্যবহার শুরু করতে পারবে তা প্রতিষ্ঠানটিও নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারছে না। এদিকে বাংলাদেশ অন্য প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত টিকা প্রাপ্তিতে কুটনৈতিক যোগযোগ এখনো শুরুই করতে পারেনি বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। চীনের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের টিকার তৃতীয় ধাপ বাংলাদেশে পরীক্ষা করার প্রস্তাব দিলেও সরকারের নীতিনির্ধারকরা সঠিক কুটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যেতে পারেনি বলেনি সুযোগটা হাত ছাড়া হয়ে গেছে। ঐ প্রতিষ্ঠানটির টিকার তৃতীয় ধাপ পরীক্ষা বাংলাদেশে করার অনুমতি দিলে শর্তানুযায়ী টিকা প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার থাকতো।
শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে বৃহত্তর জনগোষ্টির দেশ বাংলাদেশকে বসে থাকলে চলবেনা বলে বিশেষজ্ঞমহলের অভিমত। অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকার ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল না হয়ে এ পরিস্থিতিতে রাশিয়া ও চীন এবং অন্যদের থেকে টিকা পেতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বৃদ্ধি করা উচিত। চীন এবং রাশিয়া স্থানীয়ভাবে তাদের টিকা প্রয়োগ শুরু করেছে। তবে আমাদের মিডিয়াগুলো এ দুটি দেশের টিকা নিয়ে খুব একটা রিপোর্ট করে না। বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত, রাশিয়া ও চীনের টিকাগুলো পাওয়ার জন্য আমাদের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। চীন ও রাশিয়ার টিকাগুলোর প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ এগুলো প্রযুক্তিগত দিক থেকেও বেশ কার্যকর। চীন ও রাশিয়ার সাথে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা উচিত যাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দিলে আমরা তাদের টিকাগুলো পেতে পারি। যেহেতু অধিক হিমাঙ্ক তাপমাত্রায় সংগ্রহ করতে হবে ফাইজার আর মর্ডানার টিকা এবং সেই ধরনের অবকাঠামো বাংলাদেশের নাই; তাই অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকার পাশাপাশি বাংলাদেশকে খুব দ্রুত চীন ও রাশিয়ায় উৎপাদিত টিকাগুলো পাওয়ার জন্য জোর কুটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
বাংলাদেশে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, করোনা টিকা সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বিতরণ করতে যে জটিল লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা দরকার তাতে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একটি উচ্চ-পর্যায়ের কমিটি গঠন এবং টিকা সংগ্রহের আগে প্রয়োজনীয় কাজটি করার জন্য দ্রুত সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা এবং নীতিমালা তৈরি করা দরকার। টিকাটি সুষ্ঠু বিতরণের উদ্দেশ্যে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য সরকারকে বিদ্যমান কোল্ড চেইনের (শীতল সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থা) সক্ষমতা বাড়ানো এবং প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সহায়তা নিশ্চিত করা উচিত প্রায়োরিটির ভিত্তিতে।
সরকার গঠিত আট বিভাগের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল এ সম্পর্কে ইউএনবিকে বলেন, “টিকা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য বাংলাদেশকে আগেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। এটি নিশ্চিত যে যত পরিমাণ ডোজই আসুক না কেন সরকার একসাথে দেশের সব মানুষকে টিকা সরবরাহ করতে সক্ষম হবে না। এ কারণেই বিশৃঙ্খলা ও ভুল ব্যবহার এড়াতে আমাদের একটি অগ্রাধিকারের তালিকা এবং টিকানীতি দরকার।
তিনি আরও বলেন, অবিলম্বে একটি টিকা বিতরণ নীতিমালা তৈরি এবং জনগণকে এ বিষয়ে অবহিত করা প্রয়োজন। সরকারকে অবশ্যই জনগণের সাথে যোগাযোগ করতে এবং যথাযথ তথ্য প্রদান করে তাদের সামনে প্রকৃত পরিস্থিতি উপস্থাপন করে বাস্তবতা মেনে নিতে তাদের প্রস্তুত করতে হবে। অন্যথায় কিছু টিকার ডোজ দেশে এলে মানুষ হাসপাতাল ও টিকা বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে এবং সে সময়ে খারাপ কিছু ঘটতে পারে। তাই আমাদের আগে থেকেই মানুষকে জানাতে হবে যে এটি প্রথম এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কারা পেতে পারেন।
ইতিমধ্যে ফাইজার উত্পাদিত ভ্যাকসিনের জরুরি অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাজ্য ও বাহরাইন। ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ছাড়পত্র পাওয়ার আগেই ইউরোপ ও আমেরিকার ভ্যাকসিন বুথগুলোতে টিকাটি পৌঁছানোর কার্যক্রম চলছে পুরোদমে। ব্রিটেনে টিকা প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে চারটি ধাপে করোনা ভ্যাকসিন বিতরণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। বড়দিনের আগেই ভ্যাকসিন দেওয়ার কার্যক্রম শুরুর সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে ২৭ জাতিগোষ্ঠীর ইউরোপীয় ইউনিয়ন। করোনা মোকাবিলায় বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে গণহারে ‘স্পুটনিক-ভি’ ভ্যাকসিনের কর্মসূচি শুরু করেছে রাশিয়া। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের দৃশ্যমান কোন প্রস্তুতি নাই বললেই চলে।
এ সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ভ্যাকসিন বিতরণের জন্য কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট টাস্কফোর্স কমিটি, বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন করেছে সরকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গঠন করেছে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড ডেপ্লয়মেন্ট কোর কমিটি। এছাড়া কীভাবে টিকা জোগাড় করা হবে, কীভাবে সেটি দেওয়া হবে—সে বিষয়ে একটা ফ্লো চার্ট আমরা তৈরি করেছি।
একই বিষয় নিয়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে সরকার গঠিত একটি কারিগরি কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ভ্যাকসিন এলে কীভাবে তা সংরক্ষণ করা হবে, কীভাবে বণ্টন করা হবে—এরকম অনেকগুলো বিষয় নিয়ে খসড়া তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত কোভিড-১৯-এর ৩ কোটি ডোজ টিকা কিনবে। এই টিকা ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সংরক্ষণযোগ্য, এ ব্যাপারে আমাদের সক্ষমতা রয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়সহ স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্লিষ্ট সবগুলো বিভাগ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত টিকার বাইরে কিছু চিন্তা করছে না বলেই আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কাছে অন্যদের উদ্ভাবিত টিকা প্রাপ্তি নিয়ে উচ্চমহলের কোন নির্দেশনা নাই, তাই এসব নিয়ে তারা এই মুহুর্তে ভাবছে না। তাদের একমাত্র প্রতীক্ষা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার জন্য। যেটি কবে নাগাদ বাজারে আসবে তার সদুত্তর কারো কাছে নেই।
তাছাড়া বাংলাদেশে টিকা আসার পরে সুষ্ঠুভাবে বিতরণ এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা করার উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ক্ষমতাবানরা প্রাথমিক পর্যায়ে টিকা গ্রহণের চেষ্টা করবেন যেমনটি আমরা পিপিই এবং অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণের সময় দেখেছি। এ ধরনের অরাজক পরিস্থিতি টিকা নিয়েও তৈরি হতে পারে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কোনো ধরনের প্রস্তুতি বা নির্দেশনা দৃশ্যমান নয়।
এসডব্লিউ/নসদ/০৯৩০
আপনার মতামত জানানঃ