অনেক জানা-অজানা কারণে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ভারী ও মাঝারি শিল্প স্থাপন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও বন উজাড়, কৃষিতে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের ব্যবহার, কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন, কাঠ পুড়িয়ে ইট উৎপাদন, পরিবহন থেকে উত্পন্ন ধোঁয়া ও শব্দ।
বাংলাদেশের অবস্থা বিবেচনা করলে জনসংখ্যা আমাদের জন্য বিশাল চাপ। বাড়তি জনসমষ্টির জন্য খাবার, পরিধেয় ও বাসস্থান জোগাড় করতে গিয়ে কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। যেখানে সেখানে শিল্প স্থাপনের ফলে চারপাশের মাটি, বাতাস ও পানি দূষিত হয়ে যাচ্ছে।
বণিক বার্তার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পরিবেশ দূষণের দায়ে ২০১৯ সালে মিরপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় অবস্থিত তিনটি রেডিমিক্স কারখানাকে ২ লাখ করে মোট ৬ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। সে সময় সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়, মাইশা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, এবিসি বিল্ডিং প্রডাক্টস এবং করিম এক্সপোর্ট অ্যান্ড রেডিমিক্স লিমিটেডকে এ জরিমানা করা হয়েছে। এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর প্রতিক্রিয়া দেখান বড় শিল্প মালিকরা। তাদের অভিযোগ, এভাবে দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করলে প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট হয়। তাই মান বাঁচাতে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান তারা। বিষয়টি আমলে নিয়ে দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ না করার মৌখিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক একাধিক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের সার্বিক পরিবেশ সুস্থ জীবনধারণের জন্য সন্তোষজনক নয়। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বাণিজ্যিক এলাকার বায়ু, পানি, নদ-নদী দূষণে জর্জরিত। দূষণ নিয়ন্ত্রণের সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। পরিবেশ দূষণের বড় একটি কারণ শিল্প-কারখানাগুলো। যাচাই-বাছাই করে এগুলোকে ছাড়পত্র দেয়া এবং দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া এ অধিদপ্তরের অন্যতম কাজ। একইভাবে দূষণের সঙ্গে কারা জড়িত এবং তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তার তথ্য বিস্তারিতভাবে জনসম্মুখে প্রকাশ করাও পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আগে নিয়মিত তা করলেও সম্প্রতি দূষণকারী বড় প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করছে না অধিদপ্তর।
১৩ এপ্রিল পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট শাখা ঢাকা ও গাজীপুরে সাতটি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৩ লাখ টাকা জরিমানা করে। অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও জরিমানার অংক উল্লেখ থাকলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম প্রকাশ করা হয়নি। এর আগে ৭ এপ্রিল শব্দ দূষণের দায়ে একটি হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করলেও হাসপাতালটির নাম ওয়েবসাইটে দেয়া হয়নি। এমনকি কিছুদিন ধরে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট শাখা থেকে প্রকাশিত প্রেস রিলিজ ও খবরে কোনো প্রতিষ্ঠানের নামই উল্লেখ করা হচ্ছে না।
জানা গেছে, শিল্প মালিকদের আপত্তির কারণেই দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করছে না পরিবেশ অধিদপ্তর। আগে নাম উল্লেখ করা হলেও তাতে মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে আপত্তি জানান বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা। তাদের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতেই দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় অধিদপ্তর। তবে মহাপরিচালক অথবা তার অনুমতি সাপেক্ষে অন্য কর্মকর্তারা দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করতে পারবেন বলেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মৌখিক নির্দেশে সদস্যদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ সিদ্ধান্ত নেন। বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, প্রেস রিলিজ, ওয়েবসাইটের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম প্রকাশ করা যাবে না। এ নির্দেশ জেলা পর্যায়ের কার্যালয়গুলোকেও জানিয়ে দেয়া হয়। তবে বৈঠকে এ বিষয়ে কোনো লিখিত সিদ্ধান্ত হয়নি। যেহেতু সমন্বিত উদ্যোগে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তাই লিখিত আদেশের মতোই মেনে চলা হচ্ছে।
আগে নাম উল্লেখ করা হলেও তাতে মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে আপত্তি জানান বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা। তাদের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতেই দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় অধিদপ্তর।
তবে নাম প্রকাশ না করার বিষয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মাদ মাসুদ পাটোয়ারী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান পরিবেশ দূষণ করছে। সবার নাম প্রকাশ করলে তো ওয়েবসাইটে জায়গার সংকুলান হবে না। তাই আমরা শুধু সংক্ষেপে সংখ্যা উল্লেখ করছি।
প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে কোনো বাধা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো বাধা নেই। তবে আমরা আপাতত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করছি না।
এদিকে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছরে যত মৃত্যু ঘটেছে, তার চেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে পরিবেশ দুষণজনিত কারণে।
সেখানে বলা হয়েছে—কীটনাশক, প্লাস্টিক, ইলেকট্রনিক ও রাসায়নিক দুষণের কারণে গত দুই বছরে বিশ্বজুড়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৯০ লাখ মানুষ, অন্যদিকে একই সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৫৯ লাখ মানুষের।
পরিবেশ দূষণ বলতে বায়ু, পানি ও মাটি এবং কর্মক্ষেত্রে দূষিত পরিবেশের কথা বলা হয়েছে। পরিবেশ দূষণ জনিত কারণে মারা যাওয়া অধিকাংশই নিম্ম বা মধ্যম-আয়ের দেশের বাসিন্দা। এইসব দেশে প্রতি চারজনে একজন পরিবেশ দূষণ জনিত রোগ আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করা হয়েছে প্রতিবেদনে; বলা হয়েছে, ‘পরিবেশ দূষণ ও বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সদস্য রাষ্ট্রসমূহ যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেসব যে ব্যার্থ— তা ইতোমধ্যে স্পষ্ট; এবং এই ব্যার্থতার কারণেই বিশ্ববাসীর একটি পরিষ্কার, স্বাস্থ্যকর ও টেকসই পরিবেশ পাওয়ার অধিকারের লঙ্ঘণ ঘটেছে ব্যাপকমাত্রায়।’
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান দূত মিশেলে ব্যাশেলেট ইতোমধ্যে পরিবেশ দূষণকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় হুমকি বলে উল্লেখ করেছেন।
পরিবেশ দূষণের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। দূষণ জনিত মৃত্যুতে সবচেয় বড় ভূমিকা বায়ু দূষণের, যা মোট মৃত্যুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। প্রতি বছর বায়ু দূষণের কারণে ৬৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
আইকন স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপক ফিলিপ ল্যান্ডরিগান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের চেয়ে পরিবেশ দূষণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা নানা দিক দিয়ে মানবজাতির স্বাস্থ্য ও সুস্থতার উপর একটি গভীর ও বিস্তৃত হুমকি।
পৃথিবী এখনও প্রায় বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশ পরিবেশ দূষণের দিক থেকে প্রথম সারির দেশ গুলোর একটি। প্রতি বছর প্রায় গড়ে ২২ বিলিয়ন টন কার্বনডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫০-১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে।
আমি, আপনি, অন্য দশজন ঠিক যেভাবে বিষয়টিকে নিতে পারবো, হলফ করে বলতে পারি বিষয়টি তার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং ভয়াবহ। একটি জাতি নয়, একটি দেশ নয়, একটি মহাদেশও নয়- পুরো দুনিয়াটাই জড়িত হয়ে আছে বিষয়টিতে।
বিলিয়ন মানুষের বসবাসের বড় অংশ যদি চলে যায় সমুদ্রেগর্ভে, তাহলে জেগে থাকা অল্প জায়গা জুড়ে এত মানুষের ভর কেমন করে সইবে সেই সময়ের ছোট্ট ধরণী? এটুকুতেও শান্ত হবে না প্রকৃতি। বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে জেগে থাকা অংশটিও।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষার জন্য তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না, এটি ন্যক্কারজনক। যে প্রতিষ্ঠান পরিবেশ দূষণ করছে, তাদের সুনাম কেন পরিবেশ অধিদপ্তরকে রক্ষা করতে হবে সে প্রশ্ন রাখেন তারা।
তারা বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। তাদের কার্যক্রম সুস্পষ্ট হওয়া উচিত। দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম গোপন করার অধিকার তাদের নেই।
কোনো প্রতিষ্ঠান পরিবেশ দূষণ করলে তা সাধারণ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে উল্লেখ করে বলেন, সে হিসেবে দেশের মানুষের অধিকার আছে এসব প্রতিষ্ঠানের নাম জানার। পরিবেশ অধিপ্তরের কাজ দূষণকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা, তাদের মান বাঁচানো নয়। অধিদপ্তরের এমন সিদ্ধান্তের কারণে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আরো বেশি দূষণপ্রবণ হয়ে উঠবে। এসব প্রতিষ্ঠান সারা বছর দূষণ করবে, বছর শেষে কিছু টাকা জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যাবে। আবার নামটাও গোপন থাকবে। এটা তো তাদের জন্য রীতিমতো সুবর্ণ সুযোগ। দেশের পরিবেশের জন্য এটিকে বড় দুঃখজনক ঘটনা বলে মন্তব্য করেন তারা।
তারা মনে করেন, সুষ্ঠু ও সমন্বিত উদ্যোগ, বিশেষত জলাধার সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণে জনসচেতনতা, নির্বিচারে ভরাট না করা, জনপ্রতিনিধিদের নজরদারি প্রভৃতি উদ্যোগ নেয়া হলে আমাদের দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হওয়া থেকে বাঁচবে।
তারা বলেন, পরিবেশ দূষণ হ্রাস ও পরিবেশের উন্নয়নে অনেক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এর মধ্যে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ, পলিথিন-প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত করা, কলকারখানায় ইটিপি চালানো বাধ্যতামূলক করা, কৃষিতে রাসায়নিক সার, বালাইনাশক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে জৈব সার, বালাইনাশকের ব্যবহারে উৎসাহিত করা, পরিবেশ আইন অনুসরণ করতে বাধ্য করা।
যেমন বিল্ডিং কোড, কারখানা স্থাপনের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র, পরিবেশের ক্ষতি হয় কিনা তার রিপোর্ট (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট—ইআইএ) ঠিকমতো করেছে কিনা, তা যাচাই করা। সব ধরনের ময়লা (গ্রহ উৎপাদিত, মানববর্জ্য) ইত্যাদির সঠিক অপসারণ, সংরক্ষণ এবং প্রয়োজনে পুনঃউৎপাদন করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৭
আপনার মতামত জানানঃ