রাজধানী একটি দেশের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক নগরী, যা দীর্ঘদিন ধরে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। তবে বর্তমান সময়ে ঢাকার ওপর প্রচণ্ড জনসংখ্যার চাপ, যানজট, পরিবেশদূষণ ও অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে অনেকেই রাজধানী সরিয়ে নেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন। অন্যদিকে, অনেকে মনে করেন যে রাজধানী পরিবর্তন করা ব্যয়বহুল ও কঠিন হবে। তাই এ বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মানুষের চাপে হাঁসফাঁস করছে রাজধানী ঢাকা। এই চাপ কমাতে কিছু একটা করতেই হবে। হোক তা রাজধানী স্থানান্তরের মাধ্যমে, কিংবা আমাদের প্রশাসনিক খাতগুলোকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিকেন্দ্রীকরণ করে।
ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের কর্মকাণ্ড ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে আসেন। যদি রাজধানী অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে ঢাকার ওপর এই চাপ কমবে। ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যানজট। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ কর্মস্থলে যাওয়া-আসার সময় প্রচণ্ড যানজটে আটকে থাকেন, ফলে অর্থনীতি ও উৎপাদনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি ভয়াবহ বায়ুদূষণ তো আছেই।
ঢাকা শহরের পুরোনো ও অপরিকল্পিত অবকাঠামো নতুন প্রযুক্তি ও নগর পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু নতুন একটি পরিকল্পিত রাজধানী তৈরি করা হলে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, প্রশস্ত রাস্তা, উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
২০২২ সালে ইন্দোনেশিয়ার পার্লামেন্ট ঘোষণা দেয়, তারা তাদের রাজধানীকে জাকার্তা থেকে বোর্নিও দ্বীপের একটি নতুন শহর নুসানতারায় সরিয়ে নিয়ে যাবে। জাকার্তা জাভা দ্বীপে অবস্থিত। জাভা দ্বীপে রাজধানী থাকায় এখানেই ইন্দোনেশিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ বসবাস করেন। দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অর্ধেকের বেশি জাভাতেই হয়। অথচ কালিমান্তান দ্বীপটির আয়তন জাভার তুলনায় চার গুণ।
এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে দেশটির পার্লামেন্ট বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেছে। সেসব কারণের মধ্যে জাকার্তার উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব, বন্যার ঝুঁকি, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাওয়াসহ ইত্যাদি।
প্রায় একই সময়ে মিসরের সরকারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে কায়রোর ৪৫ কিলোমিটার পূর্বে একটি নতুন রাজধানী গড়ে তোলার। দেশটির বর্তমান রাজধানী প্রায়ই তীব্র যানজটে নাকাল হয়ে পড়ে। এমন যানজটের নেপথ্যে রয়েছে রাজধানীতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনিক ভবনের অবস্থান। জাকার্তা বা কায়রোর অবস্থার সঙ্গে খুব সহজেই মিল খুঁজে পাওয়া যায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার।
ঢাকাতেও ক্রমাগত ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে (যদিও অবস্থা জাকার্তার মতো অতটা খারাপ নয়)। এ শহরের বাতাসকে শ্বাস গ্রহণের অনুপযোগীই বলা চলে। শহরের ‘লাইফলাইন’ হিসেবে বিবেচিত নদীগুলো এত বেশি দূষণের শিকার হয়েছে যে সেগুলোর অবস্থা পুনরুদ্ধারের আশাও এখন ম্লান হয়ে পড়েছে। আর যানজটে স্থবির হয়ে যাওয়ার বিষয়টি তো আছেই।
দেশের ১৭ কোটি মানুষের যেন একমাত্র কর্মসংস্থানের জায়গা ঢাকা। প্রচলিত সব পণ্যের পাইকারি বাজার, ছোট-বড় শিল্প–কলকারখানা, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড—সবই ঢাকাকেন্দ্রিক। মানুষের জন্য শহরে ২৫ শতাংশ হারে রাস্তা, ১০ শতাংশ খোলা জায়গা, ১৫ শতাংশ বৃক্ষ থাকার কথা। কিন্তু সেসবের কোনো কিছুই যথার্থভাবে নেই।
বড় একটি ভূমিকম্প হলে রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে ঢাকা শহর। সবচেয়ে বড় কথা, এমনটি হলে ঢাকার রাস্তাগুলো পরিষ্কার করতে সময় অনেক মাস। এমনকি প্রশাসনিক কার্যক্রম ও ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চাপা পড়ে যাবে, যে কারণে দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা। সুতরাং ড্যাপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান কতটা ফলপ্রসূ হতে পারে, তার বিশেষণ করা আবশ্যক। ঢাকাকে বাসযোগ্য ও আধুনিক নগরীতে পরিণত করতে হলে দেশের প্রশাসনিক রাজধানী স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত অবিলম্বে গ্রহণ করা উচিত।
এমন জনবহুল শহরে বিনিয়োগ করলেও সেখান থেকে লাভ আসে অতি নগণ্য। তাই এ ধরনের শহরের অবকাঠামোয় সরকার যতই মেট্রোরেল, সাবওয়ে বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যোগ করুক না কেন, বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া কোনোভাবেই এসব বিনিয়োগ আশানুরূপ ফল বয়ে আনবে না। অর্থনৈতিক লাভ বৃদ্ধি কিংবা দীর্ঘ মেয়াদে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সব ধরনের ফলাফলই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হবে।
তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, ঢাকাকে দিয়ে যেহেতু এই রাষ্ট্রের কার্যক্রম ঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে কি আমাদের উচিত মিসর, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশের দেখানো পথ অনুসরণ করে দেশের রাজধানী ঢাকার বাইরে কোথাও সরিয়ে নিয়ে যাওয়া? কার্যত, ঠিক তা নয়।
নতুন রাজধানী গড়ে তুলতে বিশাল অর্থ ব্যয় হবে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, বিদ্যুৎ, পানিসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি করতে কয়েক লাখ কোটি টাকা লাগতে পারে, যা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ঢাকায় ইতিমধ্যে সব সরকারি দপ্তর, মন্ত্রণালয় ও বিদেশি দূতাবাস স্থাপিত রয়েছে। নতুন রাজধানীতে এগুলো স্থানান্তর করা সময়সাপেক্ষ ও কঠিন হবে। অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারীও ঢাকাকেন্দ্রিক, ফলে রাজধানী বদলালে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
একেক দেশ একেক কারণে তাদের রাজধানী স্থানান্তর করে। তাই অন্ধের মতো তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ হবে বোকামি। ইন্দোনেশিয়া জাকার্তা থেকে তাদের রাজধানী শহর সরিয়ে নিচ্ছে প্রধানত ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাওয়া এবং বন্যার উচ্চ ঝুঁকি থাকার ফলে। অন্যান্য দেশও নানা রাজনৈতিক কারণে তাদের রাজধানী পরিবর্তন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মিসরের কথা। তারা রাজধানী সরিয়ে নিচ্ছে, কারণ, দেশটির বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় বসানো সেনাবাহিনী নতুন শহরের অবকাঠামো নির্মাণ এবং বিভিন্ন সম্পদের বেচাকেনা থেকে লাভবান হতে পারবে। এদিকে সামরিক জান্তাশাসিত মিয়ানমারও তাদের প্রশাসনিক রাজধানী ইয়াঙ্গুন থেকে নেপিডোতে সরিয়ে নিয়েছে সাধারণ জনগণের থেকে সামরিক সরকারকে রক্ষার উদ্দেশ্যে।
তা ছাড়া রাজধানী শহরকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া ভীষণ ব্যয়বহুলও বটে। যেমন বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, নতুন একটি শহরে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করতে ইন্দোনেশিয়ার খরচ হবে প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলার আর মিসরের সম্ভাব্য খরচ প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার।
সেদিক থেকে চিন্তা করলে বাংলাদেশকেও তেমন কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবিস্তারে লাভ-ক্ষতির বিচার-বিশ্লেষণ করে নিতে হবে।
এর অর্থ, আমাদের উচিত প্রশাসনিক খাতগুলোকে ক্রমান্বয়ে বিকেন্দ্রীকরণ করা। এ ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় বা প্রশাসনিক খাতকে এমন কোনো অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া উচিত, যে অঞ্চলের সঙ্গে সেগুলোর অবস্থান সংগতিপূর্ণ। সূত্র: প্রথম আলো।
আপনার মতামত জানানঃ