ভারতে সংখ্যালঘুরা এখনও হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের হাতে আক্রান্ত হয়ে চলেছেন। দেশটিতে কোনো ধর্মীয় স্বাধীনতা নেই। প্রতি বছর উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে হামলার শিকার হচ্ছে সংখ্যালঘুরা।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার সিএএ চালু করেছে। এর মাধ্যমে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের অমুসলিম নাগরিকদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এটি কয়েক লাখ মুসলিমের আটক হওয়ার শঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা ভারতে ক্রমাগত নিচের দিকে যাচ্ছে। দেশটিতে হিন্দুত্ববাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলে দেশটির ধর্মীয় স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য হারে খর্ব হয়েছে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডমবিষয়ক কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
এ জন্য ভারত সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আবার সুপারিশ করেছে ওই কমিশন। ভারতের বর্তমান সরকারকে ‘হিন্দুত্ববাদী সরকার’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে তারা।
এ নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ‘ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশেষ উদ্বেগ রয়েছে’, এমন দেশগুলোর তালিকায় ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম কমিশন। যদিও ভারত সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
ভারতের মতো একটি বহু ধর্ম ও বহু সংস্কৃতির দেশেএইই ঘটনা আগের চেয়ে আরও বেড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। ধর্মের সঙ্গে জাতীয়তাবাদকে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। অ-হিন্দু ও হিন্দু দলিতদের বিরুদ্ধে হিংসা, হুমকি ও হেনস্তার ঘটনা বাড়িয়েছে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ও সংগঠনগুলো।
কী বলছে কমিশন
এই কমিশন তার বার্ষিক প্রতিবেদনে বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ তুলে ধরে। তবে কমিশন কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ করে না।
কমিশন তার বার্ষিক প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া ধর্মীয় স্বাধীনতা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পাকিস্তানকে যে কালো তালিকাভুক্ত করেছে, তাতে সম্মতি দিয়েছে কমিশন।
এদিকে ভারত ইস্যুতে ওই মার্কিন কমিশন বলছে, ‘হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র’ গড়ার লক্ষ্যে মোদি সরকার ২০২১ সালে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক হামলার ঘটনা ঘটেছে। মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের ওপর বেশি হামলা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে কমিশন।
এই বার্ষিক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য হারে খর্ব হয়েছে। ভারতজুড়ে হুমকি-ধমকি, গোষ্ঠীবদ্ধ হামলায় দায়মুক্তির সংস্কৃতি এবং সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী গ্রেপ্তারের বিষয়টিও নজরে এনেছে কমিশন।
গত বছরও এমন প্রতিবেদন দিয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম কমিশন। কিন্তু এই প্রতিবেদন খারিজ করেছিল ভারত সরকার। তখন ভারত সরকারের বক্তব্য ছিল, এই প্রতিবেদন পক্ষপাতমূলক।
তবে ভারতের সরকার অনেক সময়ই সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। গো-হত্যার নামে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করেছে। এর ফলে প্রাণহানি পর্যন্ত হয়েছে।
ধর্মীয় স্বাধীনতা আরও বেশি ক্ষুণ্ণ হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারতের ১০ রাজ্যে। এর মধ্যে রয়েছে, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, ছত্তীশগড়, গুজরাট, ওড়িষ্যা, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থান।
শরণার্থী হতে চায় ভারতীয়রা
রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভারতীয় উদ্বাস্তুর সংখ্যা ছিল ৯,৬০২ জন। শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়ের আবেদন ঝুলে রয়েছে ৫১ হাজার ৮১২ জনের। ২০১৬ সালের এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে ২৪ শতাংশ বেড়েছে শরণার্থীর সংখ্যা।
আবেদনকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৬ শতাংশ। আমেরিকা-কানাডা ছাড়াও ভারতীয়দের আশ্রয় চাওয়ার তালিকায় উপরের দিকে রয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকা (৪৩২৯), অস্ট্রেলিয়া ৩৫৮৪, ইংল্যান্ড (১৬৬৭) দক্ষিণ কোরিয়া (১৬৫৭) এবং জার্মানি (১৩১৩)।
আবার রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী কমিশনের ১০ বছরের রিপোর্ট খতিয়ে দেখলে বিষয়টা আরও উদ্বেগের। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আশ্রয় চেয়ে আবেদনের সংখ্যা বেড়েছে ৯৯৬.৩৩ শতাংশ। এবং এই সব আবেদনকারীদের একটা বড় অংশই কারণ হিসেবে ভারতে বসবাস করতে ভয় পাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেছেন। ২০০৯ সালে এই আবেদনের সংখ্যা ছিল ৪৭২২, ২০১৮ সালে যা বেড়ে হয়েছে ৫১৭৬৯।
কিন্তু এর কারণ কী? কেন দেশ ছাড়তে চাইছেন ভারতীয় সংখ্যালঘুরা? কারণ অবশ্য নানা রকম। ২০১৩ সালে আমেরিকার স্বরাষ্ট্র দফতর শরণার্থী হিসেবে ভারতীয়দের ঝুলে থাকা আবেদনগুলি গভীর ভাবে খতিয়ে দেখেছিল।
তাতে উঠে এসেছিল—শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, উগ্রপন্থা, নারীবিদ্বেষ, এলজিবিটি বিদ্বেষের মতো ঘটনার জন্য তারা আমেরিকায় আশ্রয় চেয়েছিলেন। সেই সময় সারা ভারতের যত আবেদনকারী ছিলেন, শুধু পঞ্জাবের সংখ্যাই তার চেয়ে বেশি ছিল। তাদের আশ্রয় চাওয়ার কারণ ছিল অর্থনৈতিক মন্দা, মাদক, পরিবেশগত সমস্যা এবং রাজনৈতিক উত্তেজনার মতো বিষয়।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক
কমিশন এমন প্রতিবেদন দিলেও মার্কিন সরকার ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে ইচ্ছুক। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চাইছেন।
মূলত চীনের উত্থান ঠেকাতে এই কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে কমিশনের ওই প্রতিবেদন এ বছর কতটুকু আমলে নেবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
মার্কিন এই কমিশন এমন সময়ে এই প্রতিবেদন করেছে, যার কিছুদিন পরই মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন বাইডেন। আগামী মে মাসে জাপানের টোকিওতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কৌশলগত জোট কোয়াডের বৈঠক হবে। এই বৈঠকে দুই নেতার সাক্ষাৎ হবে।
এদিকে ভারত ছাড়াও আরও কিছু দেশের বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরেছে মার্কিন কমিশন। কমিশন বলছে, আফগানিস্তান ও নাইজেরিয়াকে কালো তালিকাভুক্ত করা হোক।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩৫
আপনার মতামত জানানঃ