ঘুস-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে দেশের সাব-রেজিস্ট্রি অফিস। দিনের পর দিন অসাধু দলিল লেখকদের যোগসাজশে নামমাত্র কাগজপত্র দাখিল করে মোটা অঙ্কের ঘুসের মাধ্যমে চলছে দলিল রেজিস্ট্রির কাজ। এখানে ঘুস ছাড়া কোনো দলিল রেজিস্ট্রি করা যায় না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
দলিল সম্পাদনের নামে ঘুস দাবির অভিযোগে ঢাকার ডেমরা ও লক্ষ্মীপুরের রামগতি সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট ইউনিট।
রোববার (২৪ এপ্রিল) দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ভূঁইয়া ও মোহাম্মদ নুর আলম সিদ্দিকীর সমন্বয়ে গঠিত একটি এনফোর্সমেন্ট টিম এ অভিযান পরিচালনা করে।
ডেমরায় অভিযানকালে ছদ্মবেশে কয়েকজন দলিল লেখককে জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদক কর্মকর্তারা। এতে তারা জানতে পারেন, প্রতিটি দলিল সম্পাদনের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে অতিরিক্ত লাখপ্রতি ৫০০ টাকা সাব রেজিস্ট্রারের নামে সংগ্রহ করা হয়। একাধিক দলিল লেখকের বক্তব্যে একই তথ্য পাওয়া গেছে।
দলিল করতে আসা উপস্থিত সেবাগ্রহীতারা এনফোর্সমেন্টকে জানায়, সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে অতিরিক্ত টাকা না দিলে তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়। এ সময় এনফোর্সমেন্ট টিম দলিল দাতা ও গ্রহীতাদের হয়রানি বন্ধ করতে সাব-রেজিস্ট্রারকে মৌখিকভাবে সতর্ক করে।
এদিকে, রামগতি সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসেও একই চিত্র পেয়েছে দুদক এনফোর্সমেন্ট টিম। সেখানে দুদকের উপসহকারী পরিচালক আরিফ আহম্মদের নেতৃত্বে পৃথক অভিযান পরিচালনা করে এনফোর্সমেন্ট ইউনিট।
প্রতিটি দলিল সম্পাদনের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে অতিরিক্ত লাখপ্রতি ৫০০ টাকা সাব রেজিস্ট্রারের নামে সংগ্রহ করা হয়।
রামগতি অফিসে দুদক এনফোর্সমেন্ট ইউনিট কথা বলে জানতে পারে, সেখানে দলিল সম্পাদনে অভিযুক্ত সাব-রেজিস্ট্রার আব্দুর রহমান মুহাম্মদ তামিম দলিল দাতা ও গ্রহীতাদের হয়রানি এবং অনৈতিকভাবে অর্থ আদায় করে থাকেন। জানা গেছে, এ ব্যাপারে দুদক টিম রেকর্ডপত্র সংগ্রহপূর্বক বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করবে।
দুদক এনফোর্সমেন্ট ইউনিট রোববার ১০টি অভিযোগের বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে চারটি অভিযান পরিচালনা এবং ছয়টি দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
দুদক জানায়, রাজধানীর ডেমরার সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে ঘোষণা দলিল সম্পাদনের নামে ঘুস দাবি সংক্রান্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানকালে ছদ্মবেশে কয়েকজন দলিল লেখককে জিজ্ঞাসাবাদ করে দলটি। প্রতিটি দলিল সম্পাদনের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত লাখ প্রতি পাঁচশত টাকা সাব-রেজিস্ট্রারের নামে কালেক্ট করা হয়। একাধিক দলিল লেখকের বক্তব্যে একই তথ্য পাওয়া যায়।
দলিল করতে আসা উপস্থিত সেবাগ্রহীতারা এনফোর্সমেন্ট টিমকে জানায়, সরকার নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত টাকা না দিলে তাদেরকে হয়রানির শিকার হতে হয়। দলিল দাতা ও গ্রহীতাদের হয়রানি বন্ধে এনফোর্সমেন্ট টিম সাব-রেজিস্ট্রারকে মৌখিকভাবে সতর্ক করেছে।
দুদক জানায়, অভিযানকালে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে কমিশনে ওই টিম প্রতিবেদন দাখিল করবে।
একই দিনে লক্ষ্মীপুরের রামগতি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসেও নোয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয় থেকে একই ধরণের অভিযান পরিচালনা করা হয়।
সংস্থাটির উপ-সহকারী পরিচালক আরিফ আহম্মদের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে সাব-রেজিস্ট্রার আব্দুর রহমান মুহাম্মদ তামিমের বিরুদ্ধে দলিল দাতা-গ্রহীতাদের হয়রানি এবং অনৈতিকভাবে অর্থ আদায়ের বিষয়ে সত্যতা পাওয়া যায়। এ সময়ে টিম সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে বিভিন্ন দলিল লেখক ও সেবাগ্রহীতার সঙ্গে কথা বলে এবং অভিযোগ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে। এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করবে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভূমি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে মানুষের পরিস্কার ধারণা নেই। তাই সমস্যাটাও তারা নির্ধারণ করতে পারেন না। ফলে দালালের কাছে যান, কিন্তু সঠিক জায়গায় তারা আসেন না। তাদের না-জানা বিষয়টাকে পুঁজি করে ভূমি অফিসাররা বাড়তি টাকার বিনিময়ে কাজ করেন। এটা এখন নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। তারা জানান, ভূমি অফিসের সেবাপ্রার্থীরা সব সময়ই অসহায়। যে কোনো সাধারণ মানুষ কাজ করতে গেলে দালাল বা উক্ত অফিসের কর্মচারীদের খপ্পরে পড়তে হয়। নিয়মবহির্ভূত টাকা দিতে হয়। এই সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষের সজাগ হওয়া জরুরি।
তারা মনে করেন, সরকার দেশে যে ডিজিটালাইজেশনের সূত্রপাত করেছেন তা ভূমি অফিসগুলোর সর্বত্র বাস্তবায়ন করে হালনাগাদ যাবতীয় তথ্য সন্নিবেশ পূর্বক সংশ্লিষ্ট ইন্টারনেটে সংযোগ করে সর্বসাধারণের সার্চের সুযোগ করে দিলে (যেহেতু প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদ অফিসেও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ বর্তমান সরকার করে দিয়েছে) নিরীহ ভূমি মালিকগণ তথা সাধারণ জনগণ অহেতুক অর্থদণ্ড এবং ভোগান্তি থেকে নিষ্কৃতি পাবেন।
তারা জানান, প্রশাসন, স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে সবাই জানে ভূমি অফিসে ঘুস ছাড়া একটা ফাইলের পৃষ্ঠাও নড়ে না। সবাই সব জেনেও নিরব! সবাই সব জেনেও কী করবে, তারা পারলে এর মধ্যে থেকে কমিশন পাচ্ছে! শুধু সাধারণ জনগণের ক্ষতির খাতটা বাড়ছে। এতে তো কারো কোনো মাথা-ব্যথা নেই। শুধু ভূমি অফিস কেন, বাংলাদেশের সব জায়গায় অবৈধ অর্থ ছাড়া কাজ হয় না। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় জনসাধারণ উৎকোচ প্রদানে বাধ্য হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রায় সকল ভূমি অফিসেই জনগণকে হয়রানির শিকার হয়ে কর্মরত কর্মচারীদের ঘুস দিতে হয়। কাগজপত্র সঠিক হলেও যেমন ঘুস দিতে হয়, তেমনি কাগজপত্রে কোনো ত্রুটি থাকলেও দিতে হয় ঘুস। এমন জঘন্য ও বিশ্রী দশার কবলে নিষ্পেষিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সরকারিভাবে এমন অবস্থার প্রশমনে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
তারা মনে করেন, বাংলাদেশে ভূমি অফিসের অনিয়ম নতুন কোনো ঘটনা নয়। এ দেশের সাধারণ মানুষ বরাবরই এদের দৌরাত্ম্যে নাজেহাল। ফলে যে কোনো সাধারণ মানুষ নামজারি করা, হালনাগাদ সার্টিফিকেট, নকল তোলা প্রভৃতি ভূমি সংক্রান্ত কাজ করতে গেলে এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তিদের খপ্পরে পড়ে প্রতিনিয়তই প্রতারিত হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকতা-কর্মচারীদের জাতীয় স্বার্থে নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রবণতা ত্যাগ করা জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ