নদী ও খাল খনন প্রকল্পগুলো জাতির জন্য যেন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত তো নেই-ই, বর্ধিত মেয়াদ ও খরচেও শেষ হয় না। তিন বছরের জন্য নেয়া আট বছর আগের প্রকল্প আজো চলছে।
বন্দর নগরী চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৪ সালের জুলাই মাসে ‘বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া হতে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন’ প্রকল্প হাতে নেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ৩২৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন তা নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে।
তিন বছরের প্রকল্পটির বর্তমানে বাস্তবায়ন মেয়াদ গিয়ে ঠেকছে ১০ বছরে। সেই সঙ্গে ব্যয় বাড়ছে ১ হাজার ৩৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন (দ্বিতীয় সংশোধন) কার্যক্রমটি প্রায় আট বছর ধরে চলছে। এর মধ্যে সাত বছরে প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি মাত্র ৭৩ শতাংশ। যেখানে দু’বার সময় বাড়ানো হয়েছে চার বছর। এখন আবার মেয়াদ তিন বছর বাড়িয়ে ১০ বছরে উন্নীত করা হচ্ছে। আর বাস্তবায়ন খরচ ৩২৭ কোটি টাকা থেকে এখন এক হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে। পরিকল্পনা কমিশনের একনেক শাখা থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেটসহ বহদ্দারহাট এলাকার পানি কর্ণফুলীতে যাওয়ার জন্য বাড়ইপাড়া থেকে নদী পর্যন্ত একটি খাল খননের কথা বলা হয়েছিল ১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যানে। দিনে দিনে ভয়াবহ হয়ে ওঠা জলাবদ্ধতার কবল থেকে নগরীর বিস্তৃত এলাকা রক্ষায় খালটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নতুন খালটি বাড়ইপাড়ার চাক্তাই খালের অংশ থেকে শুরু করে বলিরহাট হয়ে কর্ণফুলীতে পড়বে। প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালটি খননের জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) অনেক আগে একটি প্রকল্প নেয়।
২০১৪ সালের ২৪ জুন একনেক থেকে প্রকল্পটি ৩২৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা খরচে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। নির্ধারিত সময়ে কাজের কোনো অগ্রগতি না থাকায় ব্যয় ৯০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে এক হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা এবং মেয়াদ আরো তিন বছর বাড়ানো হয়; কিন্তু তাতেও কোনো সাফল্য আসেনি। প্রকল্পটি বাড়তি তিন বছরেও সমাপ্ত করতে পারেনি চসিক। খরচ বৃদ্ধি ছাড়াই এরপর মেয়াদ আরো এক বছর বাড়িয়ে সতি বছরে উন্নীত করা হয়। ২০২১ সালের জুনে প্রকল্পটি বাড়তি মেয়াদে শেষ হওয়ার কথা; কিন্তু অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৭৩ শতাংশ। টাকা খরচ হয়েছে ৭২ শতাংশ বা ৯১৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ওই সময়ের মধ্যেও কাজ না হওয়ায় আবারো প্রকল্পটি সংশোধন করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। ৩২৬ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় সাত বছরের ব্যবধানে এসে দাঁড়ায় এক হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। অবশ্য পরে পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় ব্যয় কমিয়ে এক হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা করার সুপারিশ করা হয় একনেককে। মেয়াদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ বছর।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানিয়েছে, মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) একনেক সভায় প্রকল্পটি দ্বিতীয় সংশোধনের জন্য তোলা হবে। দ্বিতীয় সংশোধনীতে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় দুটোই বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের ‘বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন’ প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য ভূমি অধিগ্রহণে বিলম্ব হওয়ার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৩২৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে এক লাফে প্রকল্পের ব্যয় করা হয় ১ হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। যা বর্তমানে দ্বিতীয় সংশোধনীর প্রস্তাবে এসে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এই অর্থের মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১ হাজার ২৯৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ৬৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানায়, প্রকল্পটি মূল অনুমোদিত সময় ছিল জুলাই ২০১৪ সাল থেকে জুন ২০১৭ সাল। এরপর প্রথম সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় জুন ২০২০ সাল পর্যন্ত। কোভিড পরিস্থিতির জন্য প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে জুন ২০২১ সাল পর্যন্ত করা হয়। বর্তমানে দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবনায় প্রকল্পের মেয়াদ জুন ২০২৪ সাল করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
তিন বছরের প্রকল্পটির বর্তমানে বাস্তবায়ন মেয়াদ গিয়ে ঠেকছে ১০ বছরে। সেই সঙ্গে ব্যয় বাড়ছে ১ হাজার ৩৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে— খাল খননের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনপূর্বক নগরবাসীর নাগরিক সুবিধা বাড়ানো। খালের দুই পাশের সড়ক ও পার্শ্বস্থ ফুটপাত নির্মাণের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন করা। যানজট নিরসন ও বিনোদন সুবিধা সৃষ্টি এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা হবে।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে— ২ হাজার ৫১৭ শতাংশ ভূমি অধিগ্রহণ, ৭ হাজার ১৫৩ বর্গমিটার ভবন ক্ষতিপূরণ, ২.৮৫ লাখ ঘনমিটার মাটির কাজ, ২৬ হাজার ১০০ ঘনমিটার বালি ভরাট ও ৫ হাজার ৮০০ মিটার রাস্তা উন্নয়ন, ১৮৯ মিটার আরসিসি ব্রিজ/কালভার্ট, ৫ হাজার ৫০০ মিটার রিটেইনিং ওয়াল, ৫ হাজার ৫০০ মিটার ড্রেন ও ৫ হাজার ৫০০ মিটার ফুটপাত নির্মাণ এবং ১টি ডাবল কেবিন পিকআপ, ১টি লং বুম এস্কাভেটর ও ৫টি ডাম্প ট্রাক ক্রয় করা হবে।
প্রকল্প সংশোধনের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে- ভূমি অধিগ্রহণে বিলম্ব; নির্মাণ কাজের রেট শিডিউল ও ডিজাইন পরিবর্তনের কারণে রাস্তার উন্নয়ন, ব্রিজ/কালভার্ট, রিটেইনিং ওয়াল, ড্রেন নির্মাণ ইত্যাদি অঙ্গের ব্যয় বৃদ্ধি; স্লুইস গেইট নির্মাণ অঙ্গ বাদ দেওয়া; প্রকল্পে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নের পরিমাণ কমানো এবং প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ ৩ বছর বৃদ্ধি করা।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মামুন-আল-রশিদ বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে খাল খনন ও টেকসই অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন, জীববৈচিত্র পুনরুদ্ধার ও পরিবেশ উন্নয়ন সম্ভব হবে। এছাড়া প্রকল্পটি অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মানবসম্পদ উন্নয়ন নিয়মিতকরণ, বিনিয়োগ সহায়ক টেকসই নগর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা যেমন সড়ক সংযোগ, অবকাঠামো নির্মাণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সিটি করপোরেশনগুলোর সাংগঠনিক দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনা উন্নীতকরণ করা সম্ভব হবে। এসব বিবেচনায় প্রকল্পটি একনেকে দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পগুলোতে অনিয়ম আর দুর্নীতির কোনো অন্ত নেই। প্রায় সবকটা প্রকল্পেই অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যয় বাড়ানোর এক কৌশলও লক্ষ্য করা গেছে। প্রকল্পের সরঞ্জামাদি থেকে শুরু করে যেকোনো কেনাকাটায় রয়েছে সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতির ছোঁয়া। এসবের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিভিন্ন সময়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের সমস্ত প্রকল্পেই ঘুণপোকাদের অস্তিত্ব রয়েছে, কর্তৃপক্ষ দেখতে চাইলে অবশ্যই দেখতে পাবে। কিন্তু জানা সত্বেও প্রকল্প বিষয়ে কর্তৃপক্ষের তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায় না। অনিয়ম দুর্নীতি সমাজে এখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রুপান্তরিত হওয়ায় এসব নিয়ে আলোচনারও তেমন একটা আগ্রহ দেখানো হয় না। কেননা, দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া এবং এসব রোধে সরকারের সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ না করায় বিষয়টাতে এখন অনেকটাই ঢিলেমি চলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা কারণে অনেক প্রকল্পেরই ব্যয় বাড়তে পারে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করা গেলে সেই ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষতি পোষানো যায়। কিন্তু বিলম্বের ক্ষতি কখনোই পোষানো যায় না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৭
আপনার মতামত জানানঃ