সাধারণত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে সংখ্যালঘুদের উপরে আক্রমণ বা নির্যাতন পরিচালিত হয় না। বাংলাদেশে যেটি হয় তা হচ্ছে ‘সংখ্যালঘু রাজনীতি’। ইংরেজিতে বলা যায়, ‘দ্য মাইনোরিটি কার্ড’। নানাকারণে সংখ্যালঘুরা এই রাজনীতির শিকার হচ্ছে কয়েক দশক ধরে।
কয়েক দশক ধরে একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা, নির্যাতন ঘটলেও তার বিচার হয় না। মূল অপরাধী বা ইন্ধনদাতার পরিচয় প্রকাশ বা তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন না করার ফলে বেড়ে চলেছে নির্যাতন। এর পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর দায় স্বীকার না করা ও ক্ষেত্রবিশেষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত রয়েছে বলেও দাবি করে আসছে মানবাধিকার সংগঠনের নেতারা।
দেশে বিভিন্ন ধরনের সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও সহিংসতার ঘটনায় সামাজিক স্তরে নিন্দা-প্রতিবাদ উঠলেও মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে নীরব থাকতে বা দৃশ্যমান ভূমিকায় না আসতে দেখা যাচ্ছে। বাম-প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ছোট দলগুলো প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সোচ্চার হলেও কিছুই যেন করার নেই বড় দলগুলোর।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও সরকারবিরোধী প্রধান দল বিএনপির ভূমিকা দৃশ্যমান নয়, সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও তাই। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর এ ক্ষেত্রে নিষ্ফ্ক্রিয় ও নীরব অবস্থান সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে সাহসী করে তুলছে বলে আশঙ্কা করছে দেশের বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজ।
বিশ্নেষকরা বলছেন, কেবল সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোই নয়, নিকট অতীতে দেশে যতগুলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দলগুলোর এমন নীরব-নিস্ক্রিয় ভূমিকা দেখা গেছে। সহিংসতার শিকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য ও তাদের পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি নেতাকর্মীদের।
এমনকি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বিশেষ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য, উপজেলা-ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বার-কাউন্সিলররা কয়েকটি ক্ষেত্রে ঘটনাস্থল পরিদর্শনেও যাননি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়ায় মূলত ভোটের হিসাব মাথায় থাকার কারণেই রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা নীরব অবস্থান নিচ্ছেন, এমন অভিযোগ তুলেছেন অনেকেই।
তারা আরও বলছেন, দেশে যে কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার পর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও রাজনীতি হয়, কিন্তু বিচার হয় না। ফলে থামছে না নির্যাতনের ঘটনাও।
২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরে রামুতে বৌদ্ধপল্লীতে হামলার ঘটনা ঘটে। দশ বছর পার হলেও কোনো বিচার এখনও হয়নি। এই ঘটনায় মোট ১৯টি মামলা হয়েছিল। মাত্র একটি মামলার চার্জশিট হলেও বিচার শুরু হয়নি। ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু বসতিতে হামলার তদন্ত ছয় বছরেও শেষ হয়নি। ওই সময় যাদের আটক করা হয়েছিল তারাও জামিনে মুক্ত।
একইভাবে গত বছর ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার নানুয়াদীঘির পাড়ের পূজাম পে হামলা চালানো হয়। এরপর আরও বেশকিছু পূজাম পে হামলা করা হয়। কিন্তু সেসব ঘটনারও তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। একইভাবে রংপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ভোলায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার তদন্ত শেষ হয়নি।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বিএনপি-জামায়াত আমলে যা ছিল, এখন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও সেটাই আছে। বরং মনে হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে এটা আরও বেড়ে গেছে।
আর আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোনো আমলেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে কোনো ভূমিকা নেওয়া হয় না। ফলে আজকে দেশের সংখ্যালঘুরা অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে সরকারকে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও ঐকমত্যে আসতে হবে।
গত দূর্গাপুজায় টানা কয়েক দিন দেশের ১৬টি জেলায় এবারে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও পূজামণ্ডপ-মন্দিরে যে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতা হলো, তা দুই দশকের মধ্যে ছিল নজিরবিহীন।
ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন জাতি কিংবা ভিন্ন পরিচয় বলেই একদল নাগরিকের ওপর সহিংসতা চালানো যে হয়, এ ব্যর্থতা সমাজের। কিন্তু সরকার ও রাষ্ট্রের দায় অনেক বেশি। এর আগে রামু থেকে নাসিরনগর, প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই সহিংসতাকারীদের আইনের আওতায় আনা হয়নি। এসব ঘটনায় সরকারের তরফ থেকে ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে সামনে আনা হয়েছে। কিন্তু কখনোই সামনে আনা হয়নি সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টির পরিকল্পনাকারী আসলে কারা। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হামলা ঠেকাতে প্রতিবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে একমাত্রিকভাবে দেখার সুযোগ নেই। এর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক নানা পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। যদিও রাজনীতিতেই এটি প্রধানভাবে পুষ্ট হয়। কিন্তু পুরো প্রপঞ্চটাকে শুধু রাজনীতির ছকে ফেলে দেওয়া হলে মূল সমস্যার গভীরে কখনোই পৌঁছানো যাবে না। বরং ঘৃণা, ধর্মান্ধতা নিজেদের ঘাড়ের ওপর সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসার সুযোগ তৈরি হবে।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার অঞ্চলগুলোর উপর হওয়া প্রতিবেদন থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, নেতা কর্মীদের নিষ্ক্রিয়তা, দলীয় প্রস্তুতি না থাকা ও বিরোধের ফলে শাসক দল সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঠেকাতে ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
এর থেকেও গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে রংপুরের পীরগঞ্জে। সেখানে মাঝিপাড়ায় গরিব জেলেদের বাড়িঘর পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া এবং লুটপাটের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা। র্যাবের হাতে তিনি গ্রেপ্তার হন।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, পীরগঞ্জের বড় করিমপুরে হিন্দুপাড়ায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সৈকত মণ্ডল (২৪) নামের একজন নেতৃত্ব দেন। ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের উসকানিমূলক মন্তব্য এবং মিথ্যা পোস্টের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে স্থানীয় লোকজনকে উত্তেজিত করেন তিনি। ঘটনার দিন একটি মসজিদ থেকে মাইকিং করে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে স্থানীয় লোকজনকে জড়ো করেন তাঁর সহযোগী রবিউল ইসলাম (৩৬)। এরপরই হামলা চালানো হয়।
সৈকতের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জানা যায়, তিনি কারমাইকেল কলেজের দর্শন বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র। তিনি ওই বিভাগে ছাত্রলীগের কমিটির ১ নম্বর সহসভাপতি। ২০১৭ সালের ৮ আগস্ট ওই কমিটির অনুমোদন দেন কলেজ ছাত্রলীগ কমিটির সভাপতি সাইদুজ্জামান সিজার ও সাধারণ সম্পাদক জাবেদ আহমেদ।
ওই ঘটনার কাটত না কাটতেই টেকনাফে হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর কাটাখালী ওয়ার্ডে চাকমাপল্লিতে হামলা ও পিটিয়ে আহত করার পাশাপাশি এবং তাঁদের বৌদ্ধমন্দির ভাঙচুর এবং রান্নাঘর ও ধ্যানকক্ষে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সূত্রে জানা যায়, এতে নেতৃত্ব দেন তোফায়েল হোসেনসহ ১৩ জন। এ ঘটনায় মূল অভিযুক্ত সম্রাট কাটাখালী ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি বলে স্থানীয় লোকজনের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। যদিও হামলাকারী তাদের সংগঠনের নন বলে যথারীতি দাবি করেছে ছাত্রলীগ।
ধর্ম পরিচয়ের রাজনীতির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ১৯৫৫ সালে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির যাত্রা শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ। এ রাজনীতিই বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের ভিত গড়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যগতভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করে।
কিন্তু সেই সংগঠনেই এমন ব্যক্তিরা কীভাবে সদস্য হচ্ছেন, যারা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখেও নিষ্ক্রিয় থাকছেন, কিংবা ধর্মান্ধদের সঙ্গে নিয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নেতৃত্ব দিচ্ছেন? অস্বীকার কিংবা বহিষ্কার কিংবা অন্য দল থেকে এসে ষড়যন্ত্র করেছে—বহু ব্যবহৃত এই কৌশল কী আদৌ সমস্যার গভীরে পৌঁছতে সহযোগিতা করে? নীতি-আদর্শকে সমাহিত করে শুধু ‘সহমত ভাইদের’ সংখ্যা বাড়ানো কিংবা ঠেসে পুড়ে সমাজের সব মতাদর্শের সুবিধাবাদীদের দলে ভেড়ার সুযোগ করে দেওয়ার সামাজিক ফলাফলটা কী হচ্ছে?
পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকেই দেখা যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার সঙ্গে জড়িত অনেককে ছাত্রলীগ, যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এমনকি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর মামলার চার্জশিটভুক্ত তিন আসামিকে ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। পরে সমালোচনার মুখে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে দলটি।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৩২
আপনার মতামত জানানঃ