পাসপোর্ট অধিদফতরের আঞ্চলিক অফিসগুলো দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এসব অফিসে অলিখিতভাবে দালাল নিয়োগ দিয়ে প্রতিদিন প্রকাশ্যে চলে ঘুষের কারবার।
এভাবে দেশের ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে কর্মকর্তাদের নামে প্রতি মাসে অন্তত ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকা আদায় করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ঘুষের এ টাকা বিভিন্ন হারে ভাগ হয়ে যথাসময়ে পৌঁছে যাচ্ছে প্রধান কার্যালয়ের পদস্থ কর্মকর্তাদের পকেটেও।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার এমন প্রতিবেদনসহ অভিযোগের নথিপত্র দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ে এসেছে। যার ভিত্তিতে কমিশন থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দুদকের কাছে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতি মাসে গড়ে দুই লাখ ২৬ হাজারের বেশি পাসপোর্টের আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ জমা হয় দালালের মাধ্যমে। তাদের জমা করা আবেদনপ্রতি পাসপোর্ট কর্মকর্তারা ঘুষ নেন নির্ধারিত রেট এক হাজার টাকা করে। সে হিসাবে পাসপোর্ট আবেদন থেকে প্রতি মাসে ঘুষ আদায় হয় ১১ কোটি ৩২ লাখ টাকার বেশি। বিশাল অঙ্কের এ ঘুষের টাকা থেকে ১০ শতাংশ হারে অর্থাৎ এক কোটি সোয়া ১৩ লাখ টাকার মতো পাঠানো হয় ঢাকায় পাসপোর্টের প্রধান কার্যালয়ে।
এছাড়া আদায় হওয়া ঘুষের ৪০ শতাংশ অর্থাৎ চার কোটি ৫৩ লাখ টাকা সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক অফিসের প্রধানরা নেন। ঘুষের ১৮ থেকে ২০ শতাংশ অর্থাৎ দুই কোটি ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা পান সংশ্লিষ্ট সহকারী পরিচালকরা। বাকি ঘুষের টাকা অন্য কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।
প্রধান কার্যালয়ে আসা বিপুল অঙ্কের ঘুষের টাকা গ্রহণ ও বণ্টন করেন পাসপোর্টের অর্থ, প্রশাসন ও হিসাব শাখার চার-পাঁচজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা।
যেসব অফিসে মাসোহারা তোলা হয় তার আনুমানিক হিসাব ও পাসপোর্ট অফিসের নামের বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, ঘুষ হিসেবে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস থেকে প্রতি মাসে তোলা হয় দেড় থেকে এক লাখ টাকা, যাত্রাবাড়ী থেকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা, ময়মনসিংহ থেকে ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা, কুমিল্লা থেকে মাসভেদে এক থেকে চার লাখ টাকা, মনসুরাবাদ থেকে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা, চান্দগাঁও, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নারায়ণগঞ্জ থেকে এক লাখ টাকা করে, সিলেট ও মৌলভীবাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা করে, মাদারীপুর ও বরিশাল পাসপোর্ট অফিস থেকে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে, বগুড়া থেকে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, হবিগঞ্জ থেকে ৫০ হাজার টাকা, নরসিংদী থেকে ২৫ হাজার টাকা, ফরিদপুর থেকে ২০ হাজার টাকা, সুনামগঞ্জ থেকে ১৫ হাজার টাকা, সাতক্ষীরা থেকে ১৫ হাজার টাকা, নোয়াখালী থেকে এক লাখ টাকা, যশোর থেকে ৫০ হাজার টাকা, লক্ষ্মীপুর থেকে ১৫ হাজার টাকা, কুষ্টিয়া ও শরীয়তপুর থেকে ১০ হাজার টাকা করে, চাঁদপুর থেকে ১৫ হাজার টাকা, ঝিনাইদহ থেকে ১০ হাজার টাকা, বাগেরহাট থেকে ১০ হাজার টাকা এবং রাজশাহী ও মুন্সীগঞ্জ থেকে ২৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে আদায় হয়।
পাসপোর্ট আবেদন থেকে প্রতি মাসে ঘুষ আদায় হয় ১১ কোটি ৩২ লাখ টাকার বেশি। বিশাল অঙ্কের এ ঘুষের টাকা থেকে ১০ শতাংশ হারে অর্থাৎ এক কোটি সোয়া ১৩ লাখ টাকার মতো পাঠানো হয় ঢাকায় পাসপোর্টের প্রধান কার্যালয়ে।
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের বিষয়ে বিভিন্ন সময়েও অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগ এখন দুদকের হাতে।
এ বিষয় দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভিন্ন সময়ে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানে দালালদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। অনেক দালালকে আটক করে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। ফলে, দালালদের দৃশ্যমান উপস্থিতি কমলেও তাদের দৌরাত্ম্য কমেনি। দুদকে আসা এমন অভিযোগ অবাস্তব মনে হয়নি। আমার অভিযোগ যাচাই-বাছাই করছি। তবে, সমস্যা হচ্ছে ঘুষ লেনদেনের দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহ করা। এ বিষয়ে আমাদের চেষ্টা থাকবে। বাকিটা অনুসন্ধান শেষে বোঝা যাবে।
হয়রানি ও দুর্নীতিমুক্ত সেবাপ্রাপ্তি জনগণের সাংবিধানিক অধিকার হলেও বাস্তবতা হল, দেশে বর্তমানে ঘুষ ছাড়া কোনো সেবা পাওয়া যেন অলৌকিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি দেশের সরকারি সেবা খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম ও হয়রানির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে যে জাতীয় খানা জরিপ প্রকাশ করেছিল, সেখানে দেখা গেছে- ২০১৭ সালে সেবা খাতে ঘুষের লেনদেন হয়েছে অন্তত ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা।
সূত্র বলছে, পাসপোর্ট অফিসের ঘাটে ঘাটে ঘুষের রেট বাঁধা। নতুন পাসপোর্ট ইস্যু বা নবায়ন ছাড়াও বিদেশি নাগরিকদের ভিসা সংক্রান্ত কাজেও বড় অঙ্কের ঘুষ দিতে হয়। টাকা না দিলে হয়রানির শেষ নেই। বিশেষ করে বিভিন্ন কোম্পানিতে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের ভিসা নবায়ন, নো ভিসা ইত্যাদি কাজে বিভিন্ন রেটে ঘুষ আদায় করা হয়। বিষয়টি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট।
জানা যায়, পাসপোর্ট অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যেও দুর্নীতিবাজরা ঘাপটি মেরে রয়েছেন। এ কারণে মাঠ পর্যায়ে অফিসগুলো থেকে বিপুল অঙ্কের ঘুষের টাকা পাঠানো হয় ঢাকার ‘হেড অফিসে’। ‘চ্যানেলের টাকা’ নামে পরিচিত ঘুষের এই বিশেষ তহবিল কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে বিদেশি মিশনগুলোয় পাসপোর্ট নবায়নে ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্ট নিয়ে অনেকেই চাকরি থেকে ছাঁটাই বা বরখাস্তের ঝুঁকিতে পড়েছেন। ফলে প্রবাসী শ্রমিকদের একটি অংশ যে কোনো মূল্যে পাসপোর্ট নবায়ন করতে মরিয়া। কিন্তু তারা ঢাকায় পাসপোর্ট অফিসে যোগাযোগ করে নবায়নের জন্য বড় অঙ্কের ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
সূত্র বলছে, পাসপোর্টে বেশ কয়েকটি তথ্য সংশোধনের ওপর কড়াকড়ির কারণে ব্যাপক ঘুষ বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে নাম, পিতা-মাতার নাম এবং জন্মতারিখ সংশোধনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব বিষয়ে ঘুষের রেট খুবই চড়া। তবে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য এ ধরনের পাসপোর্ট করে নিতে অনেকে দালালদের কাছে ধরনা দেন। নাম অথবা জন্মতারিখ সংশোধনে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাসপোর্ট অধিদফতরের আঞ্চলিক অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের লাগামহীন দুর্নীতি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার খর্ব করছে এবং এর ফলে প্রান্তিক ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী ক্ষতির শিকার হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক অবদান রাখার পরও দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রবাসী শ্রমিকরা পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে গিয়ে দুর্ভোগ ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
প্রবাসী শ্রমিকসহ দেশের সাধারণ মানুষ যাতে প্রয়োজনের সময় কোনোরকম হয়রানি ও ভোগান্তি ছাড়া পাসপোর্ট পেতে পারে, সেজন্য সরকার পাসপোর্ট অধিদফতরসহ এর সব আঞ্চলিক অফিস দুর্নীতিমুক্ত করার পদক্ষেপ নেবে, এটাই কাম্য।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৬
আপনার মতামত জানানঃ