করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের শিশুরা স্কুল ছেড়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ফিরে যাচ্ছে৷ জাতীয় শ্রম আইন অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের দিয়ে কাজ করানো হলে তা শিশুশ্রম বলে গণ্য হয়। শিশুশ্রম দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়াবহ সমস্যা। অর্থনৈতিক দুরবস্থা শিশুশ্রমের প্রথম ও প্রধান কারণ। লেখাপড়ার খরচ দিতে না পেরে এবং সংসারের অসচ্ছলতার গ্লানি মা-বাবাকে বাধ্য করে তার সন্তানকে শ্রমে নিযুক্ত করতে।
সম্প্রতি এক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, পরিবারের অসচ্ছলতা ও দারিদ্রতার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হচ্ছে ৯০ শতাংশ শিশু। সম্প্রতি ৩৩৮ জন শিশুর ওপর গবেষণা ও জরিপ চালিয়ে এমনই তথ্য পেয়েছে ‘ঘাসফুল’ নামে একটি উন্নয়ন সংস্থা।
গবেষক ও সমাজবিজ্ঞানী ড. মনজুর-উল-আমিন চৌধুরীর নেতৃত্বে এ গবেষণায় উঠে এসেছে— পরিবারের অসচ্ছলতা ও দারিদ্রতার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হচ্ছে ৯০ শতাংশ শিশু। করোনা মহামারিতে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছে ৩৭ শতাংশ শিশুর পরিবার। এছাড়া পরিবহন সেক্টরে শ্রমের সঙ্গে যুক্ত শিশুদের মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে ৯১ শতাংশ শিশু। ১৩ শতাংশ হচ্ছে যৌন নির্যাতনের শিকার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন গণপরিবহনে ঝুঁকিপূর্ণভাবে কাজ করছে ১৫ হাজারের বেশি শিশু। এর মধ্যে ৫৭ শতাংশ সহকারীর পাশাপাশি চালক ও ১৫ শতাংশ শিশু কাজ করছে বিকল্প চালক হিসেবে।
তাদের এ গবেষণা বলছে, পরিবহন সেক্টরে বৈধ লাইসেন্স ও নিয়োগপত্র নিশ্চিত করতে পারলেই শিশুশ্রম প্রতিরোধ সম্ভব। এছাড়া দারিদ্র্যতার কারণে যেসব শিশুরা শ্রমের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে— তাদের সুরক্ষা করে বিকল্প ঝুঁকিহীন কাজের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। করোনার কবলে পড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন ক্ষতির সম্মুখীন তেমনি শিশুর শারিরিক ও মানসিক বিকাশও মারাত্মক আকারে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পরিবারে খাদ্য সংকটের ফলে অপুষ্টিতে ভুগছে শিশুরা। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় হয়েছে শিক্ষা থেকে বঞ্চিতও। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বেড়েছে বাল্যবিয়ে, শিশুশ্রম ও শিশুপাচার। তবে বাল্যবিয়ে শুধুমাত্র কন্যাশিশু নয়, এ প্রবণতা বেড়েছে ছেলেশিশুর ক্ষেত্রেও।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, বাংলাদেশের শিশু শ্রমিকরা প্রায় ৩৪৭ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ৪৮ ধরনের কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ ও ১৩ ধরনের কাজকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব কাজে ৭৪ লাখের বেশি শিশু যুক্ত রয়েছে। যেখানে ছেলে শিশুর সংখ্যা ৫৪ লাখ ও মেয়ে শিশুর সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি।
পরিবহন সেক্টরে শ্রমের সঙ্গে যুক্ত শিশুদের মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে ৯১ শতাংশ শিশু। ১৩ শতাংশ হচ্ছে যৌন নির্যাতনের শিকার।
শুধু বাংলাদেশ নয়, ২০২০ সালে প্রকাশিত আইএলও ও ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে- বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। যা চার বছরের ব্যবধানে বৃদ্ধি পায় ৮৪ লাখ। শিশুশ্রমে নিযুক্ত পাঁচ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধির বিষয়টি ওঠে আসে সেই প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি। শিশুদের কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরিয়ে এনে স্কুলে ফেরাবার লক্ষ্যে কর্মসূচি এবং পরিবারগুলো যেন শিশুদের কর্মক্ষেত্রে পাঠানোর সিদ্ধান্ত থেকে সর্বাগ্রে সরে আসতে পারে এমন সামাজিক সুরক্ষায় বিনিয়োগে করাকে অগ্রাধিকার প্রদানে সরকার ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর প্রতি আমরা আহ্বান জানাই।
এদিকে, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের লক্ষ্যে গত ২২ মার্চ জেনেভায় অনুষ্ঠিত আইএলও কনভেনশন ১৩৮ অনুসমর্থন করে বাংলাদেশ। কাজে যোগদানের ন্যূনতম বয়স সম্পর্কিত এ অনুসমর্থনের মাধ্যমে আইএলও’র সবক’টি মৌলিক কনভেনশন অনুসমর্থনের মাইলফলক স্পর্শ করে বাংলাদেশ।
কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বাংলাদেশের দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের শিশুরা স্কুল ছেড়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ফিরে যাচ্ছে। তবে সারা দেশে কত শিশু বর্তমানে স্কুল ছেড়ে কাজে নেমেছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নিয়মিত ৩১ হাজার শিশুকে মনিটরিং করে। এর মধ্যে প্রায় ৮ হাজার শিশুকে সংগঠনটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে স্কুলে নিয়েছিল। কিন্তু প্রায় ৩ হাজার শিশু আবারও স্কুল ছেড়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ফিরে গেছে।
শিশুশ্রম বন্ধে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এডুকো বাংলাদেশ। এ সংস্থার ‘অধিকার’ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক আফজাল কবির খান জানান, এই প্রকল্পের মাধ্যমে নগরে গৃহস্থালি কাজে এবং পরিবহন খাতে নিযুক্ত শিশুদের নিয়ে কাজ করা হয়। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে তিনটি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এডুকো বস্তি অঞ্চলে তিনটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রকল্পের মাধ্যমে ৩০০ শ্রমজীবী শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পটি চালু করার পর ২০১৯ সালের শেষের দিকে ৩০০ শ্রমজীবী শিশুর মধ্যে ১৪৬ শিশুকে সম্পূর্ণভাবে স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসে। তবে করোনাকালে তাদের পরিবারের অভিভাবকরা কর্মসংস্থান হারালে এই শিশুদের অনেকেই আবার বিভিন্ন ধরনের পেশায় যুক্ত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনা পরিস্থিতিতে শিশুরা তাদের অধিকার হারিয়েছে। শ্রমিক হিসেবে শিশুর সংখ্যা বেড়েছে। মহামারির আগেও দেশে বিভিন্ন সেক্টরে উল্লেখ্যযোগ্য শিশুশ্রমিক থাকলেও তারা সরকারি বা এনজিও পরিচালিত স্কুলে যেত। কিন্তু মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় এবং পরিবারে আর্থিক অনটনের কারণে দরিদ্র এই শিশুরা পুরো সময় কাজে নিয়োজিত হয়েছে। এখন তাদের পক্ষে আর স্কুলে ফিরে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে করোনা মহামারিতে অর্থনৈতিক ও শ্রম বাজারে ধাক্কা, মানুষের জীবিকার ওপর বিরাট প্রভাব ফেলছে৷ দুর্ভাগ্যবশত এই সংকট শিশুদের শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ দারিদ্রের কারণে শিশুদের নামতে হচ্ছে কাজে৷ করোনা মহামারিতে স্কুল বন্ধ থাকায় নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো তাদের সন্তাদের কাজে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে৷ কারণ অনেক অভিভাবকেরই মোবাইল ডাটা কিনে সন্তানকে অনলাইনে ক্লাস করানোর সক্ষমতা নেই৷
তারা বলছেন, শিশুশ্রমবিষয়ক সব নীতি ও আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮)-এ ‘হালকা শ্রম’ সংজ্ঞায়িত করা এবং আইন লঙ্ঘনের শাস্তি সুস্পষ্ট করা দরকার। গৃহকর্মে শিশুদের নিয়োগ দেওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের আওতায় আনতে হবে। জাতীয় ও কমিউনিটি পর্যায়ে শিশু সুরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করার সঙ্গে মা-বাবা এবং অভিভাবকদের শিশুশ্রমের নেতিবাচক দিক বোঝানো প্রয়োজন। গৃহকর্মসহ সব খাতে শিশুদের নিয়োজিত করার যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে, তার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা জরুরি। শিশুশ্রম নিরসন কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
আরও বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির সময় যে বিষয়গুলোতে জোর দিলে শিশুশ্রম প্রতিরোধ করা যাবে তা হলো সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, দরিদ্র পরিবারগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া, পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা এবং শিশুদের নিরাপদে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শ্রম পরিদর্শকের সংখ্যা বাড়ানো এবং পরিদর্শন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
শিশু শ্রমিকদের বেদনার কথা বলা যথেষ্ট নয়; শিশুশ্রম নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসহ সমাজের সবার আন্তরিকতা প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৩
আপনার মতামত জানানঃ