অনাস্থাভোট, ইমরান খানের পতন, প্রাণহানির আশঙ্কা আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততাকে ঘিরে উত্তপ্ত পাকিস্তান। দেশটির পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদে ইমরানে বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছেন বিরোধীরা। আগামী রোববারই প্রস্তাবটির ওপর ভোটাভুটি হতে পারে। জাতীয় পরিষদে মোট আসন ৩৪২টি। ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ১৭২টি ভোটের প্রয়োজন। জিও নিউজের হিসাব অনুযায়ী, বিরোধীদের হাতে আছে ১৯৯ ভোট।
পাকিস্তানে স্বাধীনতার পর সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের কারণে দেশটির কোনো সরকারই পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরানের ভাগ্যেও তেমনটা ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য এই প্রথম রাজনৈতিক বিরোধীদের কারণে মেয়াদ পূর্ণ করতে পারছে না কোনো সরকার।
‘আমার জীবন হুমকির মুখে’
শুক্রবার এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দাবি করেছেন, তার জীবন সংকটাপন্ন। বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে তিনি জানতে পেরেছেন হত্যা করা হতে পারে তাকে।
তবে এ পরিস্থিতিতেও তিনি ভয় পাচ্ছেন না এবং একই সঙ্গে তিনি একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবেন বলেও জানিয়েছেন।
তিনি জানান, “দেশের মানুষকে এটা জানাতে চাই, আমি প্রাণহানির আশঙ্কা করছি; বিরোধীরা আমার চরিত্রহনন করতেও ছাড়ছে না। এমনকি আমার স্ত্রীরও চরিত্র তুলে আক্রমণ করছে।”
ইমরানের অভিযোগ, প্রাণহানির আশঙ্কা তো আছেই, সেই সঙ্গে বিরোধীরাও তাকে সরাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আর সে কারণে বিদেশি শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তারা।
রোববার অনাস্থা ভোট হওয়ার আগে ইমরানের এমন দাবি পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবহাওয়াকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে।
শুক্রবার এআরওয়াই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, “স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের জন্য যত দূর লড়াই করতে হয় করব। তার জন্য আমার প্রাণহানির আশঙ্কা থাকলেও ভয় পাই না।”
ইমরানের দাবি, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তার সামনে তিনটি পথ বেছে দেওয়া হয়েছে। আর সেই পথ বেছে দিয়েছে ‘প্রতিষ্ঠান’ (পাক সেনা)। এরমধ্যে একটি হল আস্থাভোট, দ্বিতীয়টি দ্রুত নির্বাচন এবং তৃতীয় পথ হল প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা।
এই তিন পথের মধ্যে প্রথমটি হতে চলেছে রোববার। অর্থাৎ ওই দিন পাকিস্তানের ন্যাশনাল অস্যাসেম্বলিতে অনাস্থাভোটে ইমরানকে নিজের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে হবে।
ভোটাভুটিতে আস্থা রয়েছে ইমরানের। যদি সেই আস্থা ভঙ্গ হয়, তাহলে তিনি দ্রুত নির্বাচনের দ্বিতীয় পথটি বেছে নেবেন। তবে পদত্যাগ করবেন না বলে জোর গলায় আবারও জানিয়েছেন তিনি।
তিনি জানান, যদি অনাস্থাভোটে উতরে যাই, তা হলে যে শরিক দলগুলো আমাকে ছেড়ে গিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তাদের পুনরায় কোনো ভাবেই আমাদের সঙ্গে নেব না।
যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা
এবার পাকিস্তানের চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রে এক কূটনৈতিক চিঠি। পার্লামেন্টে অনাস্থার মুখে পড়া প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একে তাঁর সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ‘বিদেশি ষড়যন্ত্রের প্রমাণ’ হিসেবে দাবি করেছেন।
অন্যদিকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে ইমরান খান স্পর্শকাতর কূটনৈতিক বার্তা প্রকাশ করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন বলে অভিযোগ বিরোধীদের।
২৭ মার্চ দলের এক সমাবেশে ওই ‘হুমকির চিঠি’ দেখান ইমরান খান। নামপ্রকাশ না করে কয়েকটি সূত্রের বরাত দিয়ে গত বুধবার জিও নিউজ জানায়, একটি বিদেশি রাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের এক দূত চিঠিটি লিখেছেন।
সূত্রগুলো জানায়, সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি বিদেশি রাষ্ট্রের এক কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের পর ওই দূত পাকিস্তানে চিঠিটি পাঠান। ইমরান খান চিঠির বিষয়টি সামরিক নেতৃত্বকে অবহিত করেন। বলা হয়, কূটনৈতিক ওই চিঠিতে ‘হুমকি’ দেওয়া হয়েছিল।
ভারতে নিযুক্ত সাবেক পাকিস্তানি হাইকমিশনার আবদুল বাসিত বলেন, মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে পাকিস্তানের দূতের নেওয়া নোটের প্রতি হয়তো ইঙ্গিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। চিঠিতে দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে ওই দূতের নিজস্ব মূল্যায়নও থাকতে পারে।
পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী বলেন, পার্লামেন্টের রুদ্ধদ্বার অধিবেশনে চিঠিটি উত্থাপন করা হবে। তবে যে দেশটি পাকিস্তানকে হুমকি দিয়েছে, তাদের নাম জানানো হবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি। কারণ, এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা আইনের বিষয়টি জড়িত।
ওই ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনা ও উন্নয়নমন্ত্রী আসাদ উমর বলেন, চিঠিতে বলা হয়েছে—যদি অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়, পাকিস্তানের সব দোষ মাফ করে দেওয়া হবে। যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে পাকিস্তানের সমস্যা আরও বাড়বে।
গত বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তার সরকার উৎখাতে বিদেশি ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে প্রমাণ হিসেবে একটি দেশের পাঠানো ‘হুমকির চিঠির’ কথা উল্লেখ করেন ইমরান। এ সময় তিনি মুখ ফসকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম বলে ফেলেন।
বিষয়টি বুঝতে পেরে পরক্ষণেই কথা ঘোরানোর চেষ্টা করেন ইমরান। তিনি বলেন, ‘না, যুক্তরাষ্ট্র নয়, আমি বলতে চাইছি, চিঠিটি অন্য কোনো দেশ থেকে এসেছে।’
এদিকে, কূটনৈতিক স্পর্শকাতর বিষয় প্রকাশ করায় প্রধানমন্ত্রী ইমরানকে পাকিস্তানের ‘নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ হিসেবে অভিহিত করেছে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন)। দলটির নেতা শাহবাজ শরিফ বলেছেন, ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে দেশকে নিশানা বানিয়েছেন ইমরান।
তবে এ ধরনের চিঠি পাঠানোর বিষয়টি জোরের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সরকার ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চাচ্ছে— তার এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল শুক্রবার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে হোয়াইট হাউসের কমিউনিকেশন ডিরেক্টর কেট বেডিংফিল্ড বলেন, এ ধরনের অভিযোগের একেবারেই সত্যতা নেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ