প্লাস্টিক পুরো বিশ্বেই বহুল ব্যবহৃত একটি সামগ্রী। প্লাস্টিকের গামলা, বালতি, চায়ের কাপ, স্ট্র, পানির বোতল, কোমল পানীয়ের পাত্র ইত্যাদি রান্নাঘরের কোণ থেকে শুরু করে ঘর-গৃহস্থালির সব জায়গাতেই ব্যবহার হয়। এমনকি জুস কিংবা চা সরবরাহের জন্য হোটেলগুলোতে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার হয়ে থাকে।
অনেকেই বাসাবাড়িতে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য রাখার ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহার করে থাকেন। অপেক্ষাকৃত সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ায় প্রতিদিন আমরা নানাভাবে প্লাস্টিকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছি।
বিশেষ করে ওয়ান-টাইম ইউজ প্লাস্টিক (বোতল, কাপ, প্লেট, বক্স, চামচ, স্ট্র) দ্রব্যের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। মাছ-মাংস, শাক-সবজি, ডাল, চিনি, রসগোল্লা ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য শোভা পাচ্ছে প্লাস্টিকের মোড়কে।
আকার ও ওজনে সুবিধাজনক হলেও প্লাস্টিকের বোতল স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তা সত্ত্বেও প্লাস্টিকের বোতলে শুধু পানি, তেল, সস, বা জুস নয়, ওষুধ পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হয় যে, এটা প্লাস্টিকের যুগ।
খাবার, পানি ও নিঃশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকছে। বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো মানুষের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। এক পরীক্ষায় প্রায় ৮০% মানুষের রক্তে এই ক্ষুদ্র কণা খুঁজে পেয়েছেন তারা।
বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান। নতুন এই গবেষণা এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণার ফলাফলের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা মানুষের শরীরে চলাচলে সক্ষম এবং সেগুলো বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জায়গাও করে নিতে পারে। তবে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে এখনও জানতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।
যদিও ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে দেখেছেন, মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবকোষের ক্ষতি করে। তারা বলছেন, বায়ুতে থাকা দূষিত কণাগুলো মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে এবং ফলে বছরে কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে ফেলা হচ্ছে। মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া থেকে গভীরতম মহাসাগর পর্যন্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন পুরো পৃথিবীকেই দূষিত করছে। এরইমধ্যে খাবার ও পানীয়ের পাশাপাশি নিঃশ্বাসের সঙ্গে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা গ্রহণ করছে মানুষ। শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মলে এই কণার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
এ গবেষণায় বিজ্ঞানীরা ২২ জন অজ্ঞাত রক্তদাতার নমুনা বিশ্লেষণ করেছেন। তারা সবাই সুস্বাস্থ্যবান ও প্রাপ্তবয়স্ক। গবেষণায় তাদের মধ্যে ১৭ জনের শরীরে প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি শনাক্ত হয়। অর্ধেক নমুনায় পিইটি প্লাস্টিক পাওয়া গেছে, যা সাধারণত পানীয়ের বোতলগুলোতে ব্যবহৃত হয়। এক-তৃতীয়াংশের নমুনায় পলিস্টাইরিন পাওয়া গেছে, যা খাবার ও অন্যান্য পণ্য প্যাকেজিংয়ে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এক চতুর্থাংশ রক্তের নমুনায় পলিথিন শনাক্ত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নেদারল্যান্ডসের ভ্রিজ ইউনিভার্সিটি আমস্টারডামের ইকোটক্সিকোলজিস্ট অধ্যাপক ডিক ভেথাক বলেন, ‘মানুষের রক্তে যে পলিমার কণা রয়েছে এটির প্রথম ইঙ্গিত হলো আমাদের এই গবেষণা। এটি একটি যুগান্তকারী ফলাফল। তবে আমাদের গবেষণাকে প্রসারিত করতে হবে এবং নমুনার আকার, মূল্যায়ন করা পলিমারের সংখ্যা ইত্যাদি বাড়াতে হবে’।
কয়েকটি দল এ বিষয়ে আরও গবেষণা করছে বলে জানান তিনি।
অধ্যাপক ভেথাক বলেন, ‘মানুষের শরীরে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা রয়েছে এবং সেগুলো পুরো শরীরজুড়ে চলাচল করছে। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক’।
‘মানুষের শরীরে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা রয়েছে এবং সেগুলো পুরো শরীরজুড়ে চলাচল করছে। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক’।
তিনি আরও বলেন, ‘ইতোপূর্বে এক গবেষণায় প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মলে প্রায় ১০ গুণ বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। যেসব শিশুকে প্লাস্টিকের বোতলে খাওয়ানো হয় তাদের শরীরে প্রতিদিনই কয়েক লাখ মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা প্রবেশ করছে’।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্লাস্টিকের পাত্রে কিছু রেখে খাওয়া এবং প্লাস্টিকের বোতলে পানি পান করা ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। প্লাস্টিকের বোতলে থাকা রাসায়নিক পদার্থ খাবারের মধ্যে চলে যায়। এটি খাবার থেকে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে। শুধু তাই নয়, প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার গরম করলে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান বের হয়ে খাবারের মধ্যে প্রবেশ করে। এর ফলে ক্রমাগত বাড়ছে ক্যান্সার, অ্যাজমা, অটিজম, হরমোনজনিত সমস্যা, গর্ভপাতসহ নানা জটিল রোগ। এসব সামগ্রীর সংস্পর্শে প্রতিবছর আনুমানিক এক লাখ বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের গবেষণা রিপোর্ট অনুসারে, সারাবিশ্বে প্রতি বছর ১৬ কোটি ৫০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে পতিত হয়। সাগর থেকে মহাসাগর পর্যন্ত পতিত হয় বছরে অন্তত ১০ কোটি টন। যার ৮৫ শতাংশই ভূমি উৎস থেকে পতিত হয়। সাগরে বর্তমানে ৫ দশমিক ২৫ ট্রিলিয়ন মাইক্রো ও ম্যাক্রো প্লাস্টিকের কণা জমা রয়েছে।
এভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে সাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক কণার সংখ্যা বেশি হবে। বর্তমানে প্রতি বর্গমাইল সমুদ্রে ৫০ হাজার প্লাস্টিক টুকরা জমা রয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে হিমালয় পর্বতও রক্ষা পাচ্ছে না। এর ক্ষতি থেকে কোন দেশ বা অঞ্চলই রক্ষা পাচ্ছে না। যেসব দেশ প্লাস্টিক পণ্য বেশি উৎপাদন বা ব্যবহার করে তারা এবং যেসব দেশ উৎপাদন ও ব্যবহার কম করে তারাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রেহাই পায় না।
এক সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্লাস্টিক উৎপাদনে বছরে ব্যবহার হয় ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল। এক আউন্স পরিমাণ প্লাস্টিক বা পলিথিন প্রস্তুত করতে পাঁচ আউন্স কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুতে নির্গত হয়। এতে ব্যাপক গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া হয়। এ ছাড়া প্লাস্টিক থেকে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরিবেশবিদরা কিছুটা সোচ্চার হওয়ায় প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার নিয়ে সারাবিশ্বেই ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও ব্যবহার বন্ধে আন্দোলনও হচ্ছে। তবে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কিছুটা বাড়ছে। যথাযথ আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগ করে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার হঠাৎ করেই বন্ধ করা যাবে না। তবে প্লাস্টিক রিসাইকেল উপযোগী করা গেলে অনেক কম ক্ষতিকারক হবে। কারণ, এই বর্জ্য রিসাইকেল করে পুনরায় ব্যবহার করা যাবে। এর ফলে পরিত্যক্ত অবস্থায় যেখানে-সেখানে আর প্লাস্টিক পণ্য পড়ে থাকবে না। আর তা হলে প্লাস্টিক বর্জ্য মাটি ও পানির সঙ্গে মিশে পরিবেশের ক্ষতি করতে পারবে না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিতে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের ওপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা পালনে দেশের জনগণকে সম্পৃক্ত করা দরকার।
তারা বলেন, সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ প্রশাসন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সততা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এবং জবাবদিহিতার অভাব ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে বর্তমানে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। একইসঙ্গে রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলা।
তারা বলেন, ‘আগামী বছরগুলোতে প্লাস্টিকের ব্যবহার কি বাড়বে? আমরা অনায়াসে বলতে পারি বাড়বে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে হাত মিলিয়েই বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। তারা বলেন, অর্থনীতিতে যত বেশি প্রবৃদ্ধি আসছে প্লাস্টিকের ব্যবহারও বাড়ছে। প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে নির্মাণে, অবকাঠামো উন্নয়নে, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস শিল্পে এবং পরিবহনে।
তারা বলেন, আপনার ছোট ছোট পদক্ষেপে সমুদ্র দূষণ কমতে পারে। সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং চারপাশের মানুষকেও সমুদ্রের গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে হবে। সমুদ্রে বেড়াতে গেলে আমরা জেনে বা না বুঝে বিভিন্ন খাবারের প্যাকেটসহ বোতল বা প্লাস্টিক ইত্যাদি পানিতে ফেলে দূষিত করি। এবিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫২
আপনার মতামত জানানঃ