প্লাস্টিক পুরো বিশ্বেই বহুল ব্যবহৃত একটি সামগ্রী। প্লাস্টিকের গামলা, বালতি, চায়ের কাপ, স্ট্র, পানির বোতল, কোমল পানীয়ের পাত্র ইত্যাদি রান্নাঘরের কোণ থেকে শুরু করে ঘর-গৃহস্থালির সব জায়গাতেই ব্যবহার হয়। এমনকি জুস কিংবা চা সরবরাহের জন্য হোটেলগুলোতে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার হয়ে থাকে।
অনেকেই বাসাবাড়িতে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য রাখার ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহার করে থাকেন। অপেক্ষাকৃত সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ায় প্রতিদিন আমরা নানাভাবে প্লাস্টিকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছি।
বিশেষ করে ওয়ান-টাইম ইউজ প্লাস্টিক (বোতল, কাপ, প্লেট, বক্স, চামচ, স্ট্র) দ্রব্যের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। মাছ-মাংস, শাক-সবজি, ডাল, চিনি, রসগোল্লা ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য শোভা পাচ্ছে প্লাস্টিকের মোড়কে।
আকার ও ওজনে সুবিধাজনক হলেও প্লাস্টিকের বোতল স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তা সত্ত্বেও প্লাস্টিকের বোতলে শুধু পানি, তেল, সস, বা জুস নয়, ওষুধ পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হয় যে, এটা প্লাস্টিকের যুগ।
প্লাস্টিক দূষণই হোক কিংবা ইলেকট্রনিক বর্জ্য— পুনর্ব্যবহারই দূষণ নিয়ন্ত্রনের অন্যতম উপায়। সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর সমস্ত বৈজ্ঞানিক এবং পরিবেশকর্মীরাই সহমত এই মন্তব্যের সঙ্গে। কিন্তু প্লাস্টিক বর্জ্য যেকোনো ক্ষেত্রেই কি পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব? এবার এই প্রশ্নেরই উত্তর দিল সাম্প্রতিক গবেষণা। পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিক বোতলে জল পান নতুন করে বিপদ ডেকে আনছে বলেই আশঙ্কা প্রকাশ করলেন ব্রিটিশ গবেষকরা। প্লাস্টিক দূষণের থেকেও যা ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে মানুষের স্বাস্থ্যে।
লন্ডনের ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল জড়িত ছিলেন এই গবেষণার সঙ্গে। পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিক জলের বোতল থেকে প্রায় ১৫০টি রাসায়নিক উপাদন চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা। প্লাস্টিক থেকে বন্ধনমুক্ত হয়ে জল বা অন্য কোনো পানীয়তে যা মিশে যেতে পারে অনায়াসেই। এর মধ্যে ১৮টি রাসায়নিক উপাদানের মাত্রা দূষকের ঊর্ধ্বসীমা থেকেও বেশ খানিকটা বেশি।
বিশ্বজুড়ে খাদ্য মোড়কজাতের জন্য সবচেয়ে বেশি যে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে থার্মোপ্লাস্টিক পিইটি। একবার ব্যবহার্য পানীয়র বোতলগুলোও এ ধরনের প্লাস্টিক দিয়েই তৈরি করা হয়। এ ধরনের একক ব্যবহার্য প্লাস্টিকগুলোই সবচেয়ে বেশি বর্জ্য সৃষ্টি করে। এ বর্জ্য কমাতেই মূলত পিইটি পুনর্ব্যবহারের পরিমাণ বাড়ানো হয়। সম্প্রতি এক নির্দেশে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত ৩০ শতাংশ পিইটি বোতল পুনর্ব্যবহারের আওতায় আনতে হবে।
অন্যদিকে এ পিইটি বোতলগুলো রাসায়নিক দূষণের সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত, যার মধ্যে রয়েছে বিসফেনলের নিঃসরণ। এ রাসায়নিকের কারণে সবচেয়ে খারাপ যে সমস্যা হতে পারে তার মধ্যে প্রজননতন্ত্র-সংক্রান্ত রোগ, কার্ডিওভাস্কুলার সমস্যা ও ক্যান্সার।
পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিক বোতলে জল পান নতুন করে বিপদ ডেকে আনছে বলেই আশঙ্কা প্রকাশ করলেন ব্রিটিশ গবেষকরা। প্লাস্টিক দূষণের থেকেও যা ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে মানুষের স্বাস্থ্যে।
প্লাস্টিক বোতল থেকে রাসায়নিক নিঃসরণের বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে হওয়া ৯১টি গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করেন গবেষকরা। গবেষণায় নেতৃত্ব দেয়া ব্রুনেলের সেন্টার ফর পলিউশন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসির লেকচারার ড. ইলেনি ল্যাকোভিডৌ বলেন, আমরা দেখতে পেয়েছি যে এসব রাসায়নিক বিভিন্ন উৎস থেকে আসতে পারে। যেমন উৎপাদন পর্যায়ে ব্যবহূত বিভিন্ন পদার্থ এক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। পিইটি উৎপাদনের সময় কিছু ক্ষয় সৃষ্টি হয়। আবার একটি বোতলের স্থায়িত্বকালের যেকোনো সময়ে এ ক্ষয় হতে পারে।
জার্নালস অব হ্যাজার্ডাস ম্যাটেরিয়ালসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুনর্ব্যবহারের প্রক্রিয়ার সময় বিভিন্নভাবে রাসায়নিক দূষণের সৃষ্টি করে পিইটি বোতল। নকশাগত দুর্বলতার কারণেও পিইটি বোতলের মতো উচ্চপুনর্ব্যবহার্য পণ্যে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।
ফলে এসব বোতলে পানীয় বোতলজাত করা হলে তা রাসায়নিকের নিঃসরণ ঘটায়। এ সমস্যা সমাধানে সুপার ক্লিনিং প্রক্রিয়া ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা। যেখানে পুনর্ব্যবহারের প্রক্রিয়া শুরুর আগে তিন ধাপে পুরনো প্লাস্টিকগুলোকে উচ্চতাপে, গ্যাস দিয়ে ও রাসায়নিক দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। অবশ্য এখনই দ্বিতীয় ধাপে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের আগে প্লাস্টিকগুলো পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু এগুলোকে সুপার ক্লিনিং প্রক্রিয়া অনুসরণের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, যার মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার্য প্লাস্টিকগুলোকে ভার্জিন পিইটির কাছাকাছি নেয়া সম্ভব।
তবে ড. ইলেনি বলেন, পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়া নিরাপদ করার পাশাপাশি আমাদের ভাবা উচিত কীভাবে প্লাস্টিক ব্যবহার কমানো যায়। প্রয়োজনে আলাদাভাবে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। সাধারণ মানুষকে জানতে হবে যে কীভাবে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হয়। আমরা যদি পিইটি বোতল কম ব্যবহার করি তাহলে তা আমাদের চারপাশকেই ভালো রাখবে।
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা, যা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকে একটি একক পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের একাধিক কারণ আমাদের সামনে দণ্ডায়মান। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে এটি যতটা না প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট, তার থেকেও বেশি মানবসৃষ্ট। মানবসৃষ্ট একাধিক কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে প্লাস্টিক।
প্লাস্টিক হলো সিনথেটিক বা সেমি-সিনথেটিক ও নিম্ন গলনাঙ্কবিশিষ্ট পদার্থ, যা তাপীয় অবস্থায় যেকোনো আকার ধারণ করতে পারে এবং পুনরায় কঠিনে রূপান্তরিত হতে পারে। প্লাস্টিক স্থায়ী, সহজলভ্য, সস্তা এবং সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় আমরা সবাই প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল এমনকি উন্নত দেশেও প্লাস্টিক একটি নিত্য ব্যবহার্য বস্তু। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য প্লাস্টিক চাহিদা ব্যাপক। দিনের পর দিন প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে।
প্লাস্টিক মাটি ও পানিতে ফেললে পচে না, গলেও না। প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার শেষে মাটি কিংবা পানিতে ফেলে দেয়ার পর তা থেকে যায় অনন্তকাল। প্লাস্টিকদ্রব্য এবং এর উপজাত, কণিকা বা নিঃসরিত অণুর সংযোজন জল ও স্থলে মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান ছড়ায়। এর ফলে মানুষসহ পুরো জীবজগত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, মাটি ও পানিতে খাদ্যচক্রের প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিক নিঃসৃত ভয়াবহ ক্ষতিকর পদার্থও মিশে যায়, যা খেয়ে মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণী এমনকি উদ্ভিদও নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, এর বিরূপ প্রভাবে মানবদেহে ক্যান্সার, এ্যাজমা, অটিজম, হরমোনজনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি হয়। পরিবেশবিদদের মতে, প্লাস্টিক দূষণ ইকোসিস্টেমের (বাস্তুতন্ত্র) জন্য অশনি সঙ্কেত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে মানুষসহ সমগ্র জীবজগত। তাই প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক না হলে রয়েছে মহা বিপদের শঙ্কা।
পরিবেশবিদরা কিছুটা সোচ্চার হওয়ায় প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার নিয়ে সারাবিশ্বেই ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও ব্যবহার বন্ধে আন্দোলনও হচ্ছে। তবে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কিছুটা বাড়ছে। যথাযথ আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগ করে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার হঠাৎ করেই বন্ধ করা যাবে না। তবে প্লাস্টিক রিসাইকেল উপযোগী করা গেলে অনেক কম ক্ষতিকারক হবে। কারণ, এই বর্জ্য রিসাইকেল করে পুনরায় ব্যবহার করা যাবে। এর ফলে পরিত্যক্ত অবস্থায় যেখানে-সেখানে আর প্লাস্টিক পণ্য পড়ে থাকবে না। আর তা হলে প্লাস্টিক বর্জ্য মাটি ও পানির সঙ্গে মিশে পরিবেশের ক্ষতি করতে পারবে না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিতে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের ওপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা পালনে দেশের জনগণকে সম্পৃক্ত করা দরকার।
তারা বলেন, সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ প্রশাসন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সততা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এবং জবাবদিহিতার অভাব ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে বর্তমানে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। একইসঙ্গে রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলা।
তারা বলেন, ‘আগামী বছরগুলোতে প্লাস্টিকের ব্যবহার কি বাড়বে? আমরা অনায়াসে বলতে পারি বাড়বে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে হাত মিলিয়েই বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। তারা বলেন, অর্থনীতিতে যত বেশি প্রবৃদ্ধি আসছে প্লাস্টিকের ব্যবহারও বাড়ছে। প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে নির্মাণে, অবকাঠামো উন্নয়নে, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস শিল্পে এবং পরিবহনে।
তারা বলেন, আপনার ছোট ছোট পদক্ষেপে সমুদ্র দূষণ কমতে পারে। সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং চারপাশের মানুষকেও সমুদ্রের গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে হবে। সমুদ্রে বেড়াতে গেলে আমরা জেনে বা না বুঝে বিভিন্ন খাবারের প্যাকেটসহ বোতল বা প্লাস্টিক ইত্যাদি পানিতে ফেলে দূষিত করি। এবিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১২
আপনার মতামত জানানঃ