রাশিয়ার ওপর দেয়া নিষেধাজ্ঞা পুতিনের আচরণ পরিবর্তনের কোনো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে না। উল্টো এটি আমেরিকান নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে বেইজিংকে দেয়া সবচেয়ে বড় উপহারগুলোর মধ্যে একটি।
প্রাকৃতিক সম্পদে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ রাশিয়াকে কার্যকরভাবে বেইজিংয়ের পকেটে রাখার মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞাগুলো সম্পদ-ক্ষুধার্ত চীনকে বড় লভ্যাংশ দেবে। এতে করে চীন রাশিয়ার সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের শর্ত নির্ধারণ করতে পারবে এবং তাদের জন্য রুশ সামরিক প্রযুক্তির দ্বার আরও বেশি খুলে দেয়ার নিশ্চয়তা পাবে।
ইউক্রেন যুদ্ধ বদলে দিচ্ছে অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সমীকরণ। রাশিয়ার উপর দেয়া নিষেধাজ্ঞা হয়তো কেন্দ্র থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দেবে, নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে চীন। যুদ্ধে সরাসরি না হলেও অবধারিতভাবে জড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এই সুযোগেই টক্কর দেয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে উঠছে চীন।
সম্প্রতি রাশিয়া-আমেরিকা দ্বন্দ্বের সুযোগ কীভাবে চীন নিচ্ছে, সে বিষয়ে একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আমেরিকাভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য হিল। আসুন জানা যায় এই প্রতিবেদন সম্পর্কে।
রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা রাশিয়ার
ইউক্রেনে আগ্রাসনের জেরে রাশিয়ার ওপর নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। তার জবাবে দেশগুলিতে ২০২২ সালের শেষপর্যন্ত বেশকিছু পণ্য রপ্তানি বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে মস্কো।
রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় রয়েছে টেলিকম, মেডিকেল, যানবাহন, কৃষি ও ইলেকট্রিক্যাল সরঞ্জামের মতো পণ্য। এছাড়া, কাঠের মতো কিছু বনজ পণ্য রপ্তানিও বন্ধ থাকবে।
রাশিয়ার অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রাশিয়ার বন্দরে বিদেশি জাহাজ ভেড়াও অচিরেই বিধিনিষেধের আওতায় পড়তে পারে। মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, “রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া হিসেবেই এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।”
“যেসব দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক আচরণ করেছে, তাদের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো যেন ব্যাহত হয় তা নিশ্চিত করতে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো। এতে রাশিয়ার অর্থনীতির এই (রপ্তানি) খাতগুলো প্রভাবিত হবে না।”
রাশিয়ার নতুন রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও আমেরিকাসহ ৪৮টি দেশ। রুশ প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্তিন বলেছেন, রাশিয়ায় অবস্থিত বিদেশি মালিকানার কোম্পানিগুলোর রপ্তানিও এর আওতায় থাকবে। এসব কোম্পানির উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে আছে- মোটরকার, রেলওয়ে ক্যারেজ, কন্টেইনার ইত্যাদি।
নিষেধাজ্ঞার প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্র এমন একসময়ে রাশিয়াকে পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন আর্থিক ব্যবস্থা থেকে কার্যত অচ্ছুৎ ঘোষণা করেছে যখন অর্থনৈতিক শক্তি পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিশ্বের ১১তম বৃহত্তম অর্থনীতিকে বহিষ্কার করার এই পদক্ষেপ পশ্চিমা আধিপত্যহীন একটি কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থা গঠনকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
আর যে বিষয়টি নিশ্চিতভাবে ঘটতে যাচ্ছে সেটি হলো, রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব নিষেধাজ্ঞা কেন্দ্র করে ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে অঘোষিত বেইজিং-মস্কো জোটকে আরও শক্তিশালী হতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি চীনকে আর্থিক ও ভূরাজনৈতিকভাবে লাভবান করে তুলবে। ফলে বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্প্রসারণের সুযোগ আরও বাড়বে।
আন্তর্জাতিক সুইফট পেমেন্ট সিস্টেম থেকে রাশিয়ান ব্যাংকগুলোকে নিষিদ্ধ করাসহ মস্কোর ওপর পশ্চিমের বড় অর্থনৈতিক জরিমানার কারণে রাশিয়া এখন চীনকে ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করতে প্রস্তুত। এ কারণে চীন বিশাল মুনাফা পেতে পারে।
কাঠামোগত দিক থেকেও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞায় চীনের লাভ হবে। তাইওয়ান আক্রমণ করলে একই ধরনের পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে বেইজিং অর্থ প্রদান ও রিজার্ভে ইউয়ানের ভূমিকা বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
একই সঙ্গে তারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সুইফটের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম বা সিআইপিএসের ব্যবহার বাড়ানোর ওপরও জোর দিচ্ছে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞা এসব প্রচেষ্টাকে পূর্ণতা দান করবে।
পাশাপাশি রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞাগুলো চীনের জন্য বৃহত্তর ভূমিভিত্তিক আমদানির মাধ্যমে একটি জ্বালানি সুরক্ষা তৈরির পথ খুলে দিয়েছে। এর ফলে তাইওয়ানে আক্রমণের ক্ষেত্রে চীন আমেরিকার সম্ভাব্য জ্বালানি নিষেধাজ্ঞা বা অবরোধ প্রতিহত করতে পারবে।
নর্ড স্ট্রিম টু গ্যাস পাইপলাইনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বেইজিংয়ের জন্য স্বস্তির খবর। গত মাসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বেইজিং সফরের সময় ১১৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের নতুন চুক্তি করার মাধ্যমে তেল ও গ্যাস আমদানি আরও বাড়াতে চাইছে চীন।
এখানেই আছে একটি প্যারাডক্স। হংকং দখল করে দক্ষিণ চীন সাগরের ভূরাজনৈতিক মানচিত্র পাল্টে দেয়ার পরও চীনকে এখন পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের কোনো বড়সড় নিষেধাজ্ঞা সামনে পড়তে হয়নি। তারা হিমালয় অঞ্চলে স্থলসীমান্ত প্রসারিত করেছে ও ১০ লাখের বেশি বন্দি নিয়ে একটি ‘মুসলিম গুলাগ’ প্রতিষ্ঠা করেছে। যাকে পরপর দুটি আমেরিকান প্রশাসন ‘গণহত্যা’ ও ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
বাইডেনের দুই দফা নিষেধাজ্ঞা গত বছর তেমন কার্যকর হয়নি। পাশাপাশি রাশিয়া গত এক দশকে আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার জন্য একটি সহজ লক্ষ্য হিসেবে রয়ে গেছে, কারণ রাশিয়ার অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের খুব বেশি অংশ নেই।
এই আলোকে শুধু রাশিয়াকে পশ্চিমাদের টার্গেট করা চীনকে প্রধান সুবিধাভোগী করে তুলবে এবং বিশ্বের প্রধান শক্তির অবস্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে হঠানোর যে ‘চায়না ড্রিম’ প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের রয়েছে তা বাস্তবায়নে সহায়ক হবে।
পশ্চিমারা চীনের পেছনে না লাগলে জিনপিং রাশিয়ার বিরুদ্ধে বাইডেনের নতুন নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমিয়ে আনবেন।
পশ্চিমের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছাড় নেয়ার কূটনৈতিক কৌশল হিসেবে বেইজিং রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বিড়াল-ইঁদুর খেলা খেলবে, যা উত্তর কোরিয়ার নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তারা দীর্ঘদিন খেলেছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে নীরবভাবে খর্ব করার সময় বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করার ভান করবে, একই সঙ্গে রাশিয়াকে চীনকেন্দ্রিক আর্থিক সমাধান খুঁজে পেতে সহায়তা করবে।
চীনের উচ্চাকাঙ্খা
ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের বিরুদ্ধে ক্ষোভের ক্ষেত্রে মূল বিষয়টিতে নজর হারানো উচিত নয়। সেটি হচ্ছে রাশিয়ার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি জনসংখ্যা ও অর্থনীতির চীন আমেরিকার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রাশিয়ার কৌশলগত অগ্রাধিকার ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা কেবল তার প্রতিবেশী অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত। আর চীন প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে গোটা বিশ্বের সামনে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হয়ে উঠতে কাজ করছে।
এফবিআইয়ের পরিচালক ক্রিস্টোফার রে গত মাসে দ্য হিলকে বলেন, ‘আমাদের ধারণা, আমাদের উদ্ভাবন এবং আমাদের অর্থনীতির নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চীনের চেয়ে বড় হুমকির কোনো দেশ আর নেই। তাদের হ্যাকিং প্রোগ্রামের পরিধি অন্য সব দেশের চেয়ে বেশি।’
রের মতে, চীন তার গুপ্তচরবৃত্তির মাত্রা যুক্তরাষ্ট্রে এমনভাবে প্রসারিত করেছে যে এফবিআইকে গড়ে প্রতি ১২ ঘণ্টায় একটি নতুন কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স তদন্ত করতে হয়েছে।
বৈশ্বিক ভাবমূর্তিতে ঐতিহাসিকভাবে সর্বনিম্ন অবস্থান চীনের। সেই দেশটির জন্য ওয়াশিংটন-মস্কোর নতুন কোল্ড ওয়ারের মতো ভালো সময় আর হয় না। জিনপিং বড় ঝুঁকি নেয়ার জন্য ক্রমবর্ধমান উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখিয়েছেন। তার বিশ্বাস, জনসংখ্যাগত সংকট, স্থবির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও একটি প্রতিকূল বৈশ্বিক পরিবেশের মুখোমুখি হওয়ার আগে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা পরিবর্তনের কৌশলগত একটি ছোট সুযোগ রয়েছে।
পুতিন তার সামরিক অভিযানের মাধ্যমে অজান্তেই বেইজিংকে সাহায্য করছেন। এর মধ্যে রয়েছে চীনা চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রকে বিভ্রান্ত করা। রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে একটি বিপজ্জনক সংঘাতের সৃষ্টি করা এ যুদ্ধ জিনপিংকে তার ‘চায়না ড্রিম’ বাস্তবায়নে সাহায্য করবে।
বাইডেন সম্ভবত রাশিয়াকে ‘অর্থনৈতিক ও কৌশলগত’ চরম মূল্য দেয়ানোর অঙ্গীকার পূরণ করবেন। ব্যাপকভাবে প্রতিকূল একটি দেশ ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণ করতে যাওয়া রাশিয়া এক ঘোলাটে পরিস্থিতিতে পড়তে পারে। বিশেষ করে পশ্চিমারা যখন প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনের বাহিনীকে সহায়তা করছে।
ইউরোপীয় নিরাপত্তার ঘাটতি
ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য কংগ্রেসের কাছে বাইডেনের অতিরিক্ত ১০ বিলিয়ন ডলারের অনুরোধ প্রমাণ করছে যে, তার এবারের নিষেধাজ্ঞার কৌশলটিতে ১৯৮০-র দশকে আফগানিস্তানে সিআইএর নেতৃত্বে গোপন যুদ্ধের মতো একটি পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যে পরিকল্পনার আওতায় আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েতদের তাড়িয়ে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
ইউরোপীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান জটিলতা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনা সম্প্রসারণবাদের জন্য আরও বড় জায়গা ছেড়ে দেবে। এ অঞ্চলটিই বিশ্বব্যবস্থাকে নতুন রূপ দেবে। প্রকৃতপক্ষে আমেরিকান নীতি রাশিয়া ও চীনের মধ্যে একটি ফাটল তৈরির বদলে সেতু হিসেবে কাজ করছে। এটি দেশ দুটিকে বাড়তি চাপে থাকা আমেরিকার বিরুদ্ধে একত্রিত করেছে।
আরও মৌলিকভাবে দেখলে, রিচার্ড নিক্সন থেকে বারাক ওবামা পর্যন্ত একের পর এক আমেরিকান প্রেসিডেন্টের অধীনে চীন ইস্যুতে করা কৌশলগত ভুল থেকে খুব কম শিক্ষা নিয়েছে আমেরিকান নীতি। এর ফলে চীন আজ এমন একটি সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, যা আমেরিকা আগে মোকাবিলা করেনি।
কোল্ড ওয়ার-পরবর্তী সময়ে প্রায় প্রতিবারই যুক্তরাষ্ট্র যখন কোনো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, ততবার তারা চীনের বাণিজ্যিক ও কৌশলগত স্বার্থকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।
আফগানিস্তানে পরাজয় ও ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থতার পর তাইওয়ানে কি বাইডেনের পরবর্তী পররাষ্ট্রনীতির বিপর্যয় ঘটতে পারে? জিনপিং সম্ভবত এখন সময় নেবেন এবং তাইওয়ান আক্রমণের যাওয়ার জন্য উপযুক্ত মুহূর্তের অপেক্ষা করবেন।
আর সেটি হবে হতবাক হয়ে পড়া যুক্তরাষ্ট্রকে বিভ্রান্ত করা ও পশ্চিমের শক্তিকে শীর্ষস্থান থেকে নামিয়ে আনার মুহূর্ত।
আপনার মতামত জানানঃ