করোনা মহামারিতে দুই বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নানা কারণে ঝরে পড়ছে বহু শিক্ষার্থী। এদের একটি বড় অংশ শিকার হয়েছে বাল্যবিয়ের। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ছাত্রীরা বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এক বিদ্যালয়েই শতাধিক ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে এমন তথ্যও আছে। আবার একই গ্রামে একাধিক বাল্যবিয়ের ঘটনাও আছে। উপকূলীয় ও হাওড়াঞ্চলে অনেক ছাত্রীর মাথায় সংসারের বোঝা চেপেছে। অভাব-অনটনের কারণে বাবা-মা অনেকটা গোপনেই অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছেন সন্তানদের। এই ছাত্রীদের আর ক্লাসে ফেরার সম্ভাবনা নেই।
করোনাকালে দুই বছর শিক্ষাঙ্গন বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থীই আর স্কুলে ফিরবে না। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে না পেরে অনেক ছাত্র-ছাত্রী এরই মধ্যে বিভিন্ন কাজে জড়িয়েছে। জোর করে অনেক মেয়েকে বাল্যবিয়ে দেওয়া হয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারির পর বিশ্বব্যাপী ১ কোটি ১০ লাখের বেশি মেয়েশিশু স্কুলে নাও ফিরতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ।
মঙ্গলবার(৮ মার্চ) আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল এক বিবৃতিতে এ শঙ্কার কথা বলেন।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ মেয়েদের জীবন ধ্বংস করছে। স্কুল বন্ধ, অর্থনৈতিক চাপ এবং পরিষেবার ব্যাঘাত সবচেয়ে অরক্ষিত মেয়েদের স্বাস্থ্য, সামগ্রিক কল্যাণ ও ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। বিশ্বব্যাপী ১ কোটি ১০ লাখের বেশি মেয়ে মহামারির পরে স্কুলে নাও ফিরতে পারে।’
আগামী এক দশকে আরও এক কোটি মেয়েশিশু বিয়ের ঝুঁকিতে আছে বলে মন্তব্য করেন ক্যাথরিন রাসেল।
তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু লকডাউন শিশুদের আরও বেশি সময় তাদের বাড়িতে কাটাতে বাধ্য করে, এ ক্ষেত্রে গৃহস্থালি কাজের বেশির ভাগই মেয়েদের কাঁধে বর্তায়। অনেকে তাদের নির্যাতনকারীর সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে বাধ্য হচ্ছে এবং তাদের সুরক্ষার জন্য সহায়ক– এমন সেবা ও কমিউনিটি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকছে। যৌন সহিংসতাসহ লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বাড়ছে।’
মেয়েদের অবশ্যই বৈশ্বিক, জাতীয় এবং স্থানীয় মহামারি মোকাবিলা ও পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার কেন্দ্রে রাখার আহ্বান জানান ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ।
তিনি বলেন, ‘মেয়েদের শিক্ষা পুনরায় শুরু করার সুযোগ দিতে স্কুলগুলো খোলা রাখা এবং যারা পিছিয়ে পড়েছে তাদের ঘাটতি পূরণে সহায়তা দিতে প্রয়োজনীয় সম্পদের পেছনে বিনিয়োগ করতে হবে।’
মেয়েদের শিক্ষা পুনরায় শুরু করার সুযোগ দিতে স্কুলগুলো খোলা রাখা এবং যারা পিছিয়ে পড়েছে তাদের ঘাটতি পূরণে সহায়তা দিতে প্রয়োজনীয় সম্পদের পেছনে বিনিয়োগ করতে হবে।’
২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয় দুই দফায়। প্রথম দফায় প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে শিক্ষাঙ্গনের দুয়ার।
সশরীরে ক্লাস শুরু হয় মাধ্যমিক স্কুলে। এরপর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। সবার পর সশরীরে ক্লাস শুরু হয় প্রাথমিকে। করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে দ্বিতীয় দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে ক্লাস বন্ধ করে দেয়া হয় গত ২১ জানুয়ারি। এ দফায় শিক্ষাঙ্গনে সশরীরে ক্লাস বন্ধ থাকে এক মাস।
২২ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। আর ২ মার্চ থেকে আবারও শুরু হয় প্রাথমিকে সশরীরে ক্লাস। সার্বিক পরিস্থিতিতে অনেক মেয়ে শিক্ষার্থীর ক্লাসে ফেরা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবছর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগে প্রায় ১৭ শতাংশ ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষের আগে প্রায় ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এর পেছনে অন্যতম কারণ দারিদ্র্য ও বাল্যবিয়ে। বিশেষ করে শহরের বস্তি এবং চর ও হাওর অঞ্চলের শিশুরাই বেশি স্কুলের পথ ভুলতে থাকে। করোনার কারণে এসব পরিবারে দারিদ্র্য আগের চেয়ে বেড়েছে। এ ছাড়া নতুন নতুন পরিবারও দরিদ্র হয়েছে। ফলে ঝরে পড়ার হার আরো বাড়বে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেখানে ধার করে সংসার চালাচ্ছেন, সেখানে দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারটি মাথায়ই রাখেনি। এসব দরিদ্র পরিবারের অনেক সন্তান শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে, যারা আর স্কুলে না-ও ফিরতে পারে।
জাতিসঙ্ঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, বাল্যবিয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থতম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে মেয়েদের ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের বিয়ে হচ্ছে ১৫ বছরের আগেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ ছেলেদের সমান বা কিছু বেশি হলেও উচ্চশিক্ষা এবং চাকরিতে অনেক পিছিয়ে মেয়েরা। বর্তমানে সরকারি চাকুরেদের মধ্যে নারী মাত্র ২৭ শতাংশ।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ। মেয়েদের এই পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ বাল্যবিয়ে। শিশু মেয়ে হয় শিশু মা। ফলে বাড়ে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার। বাল্যবিয়ে বন্ধে এখনই উদ্যোগ না নিলে চ্যালেঞ্জ হবে এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে। বিশ্বজুড়ে ১৮ বছরের বেশি বয়সে বিবাহিত মেয়েদের তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিতা মেয়েরা।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র্য দেশে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। করোনা মহামারি দরিদ্রের সংখ্যা আরও বাড়িয়েছে। অভাবের কারণে দরিদ্র পরিবারের অভিভাবক অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সংসারের খরচ কমাতে চান। বিয়ের পর মেয়েটির স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়।
তারা বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা, প্রতি মাসে উপবৃত্তি প্রদান নিশ্চিত করা এবং দুপুরের খাবার নিয়মিত দেওয়া হলে দরিদ্র অভিভাবকরা মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী হবেন। তারা তখন আর মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবেন না। এতে বাল্যবিয়ে কমবে, নারী শিক্ষার হারও বাড়বে।
আরও বলেন, বাল্যবিয়ে স্থায়ীভাবে প্রতিরোধ করতে প্রথমেই প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। বাল্যবিয়ের কুফল সব অভিভাবককে বুঝতে হবে, অথবা তাদের বোঝাতে হবে। ছেলেমেয়েদেরও বোঝাতে হবে যে, অল্প বয়সে বিয়ে করা ভালো নয়। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সর্বত্র প্রচার-প্রপাগান্ডা চালিয়ে যেতে হবে। যেসব কারণে বাল্যবিয়ে হয়, তা দূর করার জন্য অভিভাবক, সমাজ ও সরকারকে সমন্বিতভাবে কাজ করে যেতে হবে। একইসঙ্গে জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটিগুলোকে কার্যকরভাবে সক্রিয় রাখা প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১০৩৩
আপনার মতামত জানানঃ