দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নির্যাতনের খবরে শিউরে উঠছে সারা দেশ। যদিও মাদ্রাসাগুলোতে ক্রমবর্ধমান এই ধর্ষণ নিয়ে মাথাব্যথা নেই সরকারের। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব নয়। নেই বার্ষিক কোন প্রতিবেদন। তাই এই সব নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র থেকে যাচ্ছে অজানা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা লজ্জা, ভয়, নানান কিছুর কারণে তা প্রকাশ করে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সবথেকে কম কথা বলা হয়। এর কারণ হয়তো সেক্স, অপ্রাপ্তবয়স্ক ভুক্তভোগী এবং ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মানুষের অন্ধবিশ্বাস।
এরই ধারাবাহিকতায় এবার রাজধানীর সবুজবাগ থানার মাদারটেক এলাকায় ‘মাদ্রাসাশিক্ষকের মারধরে’ জখম হয়েছে এক শিশুশিক্ষার্থী।
মাদারটেক আদর্শপাড়া আইনুল কোরআন মাদ্রাসায় গত ২৮ ফেব্রুয়ারি এ ঘটনা ঘটে।
গুরুতর আহত ১০ বছর বয়সী শিক্ষার্থীর নাম ইয়াসিন শিকদার। তাকে মারধরের অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে মাদ্রাসার শিক্ষক রেজাউল করিমকে।
দুটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার পর রোববার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ইয়াসিনকে।
তার মা তানিয়া আক্তার বলেন, ‘আমাদের বাসা সবুজবাগ উত্তরপাড়া এলাকায়। ইয়াছিন মাদারটেক আদর্শপাড়া আইনুল কোরআন মাদ্রাসায় প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। মাদ্রাসার শিক্ষক রেজাউল করিম পড়াশোনার অজুহাতে প্রায় সময় মারধর করত।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে মাদ্রাসায় তার ক্লাসরুমে শিক্ষক রেজাউল করিম ইয়াছিনকে মাথা ধরে দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা দেয় এবং মুখে কিল, ঘুষি মারে; ইয়াছিন মাথায় গুরুতর আঘাত পায়।
‘পরের দিন মাদ্রাসা থেকে ফোন আসে, ‘আপনার ছেলে মাথায় আঘাত পেয়েছে, আপনি মাদ্রাসায় আসেন।’ খবর শুনে ছুটে যাই মাদ্রাসায়। পরে ইয়াছিনকে আমারা মাদ্রাসা থেকে নিয়ে ফরাজি ও খিদমা হাসপাতালে চিকিৎসা দেই। তার অবস্থার অবনতি ঘটলে আজ (রোববার) রাতে তাকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে আসি’।
মাদ্রাসায় তার ক্লাসরুমে শিক্ষক রেজাউল করিম ইয়াছিনকে মাথা ধরে দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা দেয় এবং মুখে কিল, ঘুষি মারে; ইয়াছিন মাথায় গুরুতর আঘাত পায়।
সবুজবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কামরুল হাসান সুমন বলেন, ‘এই ঘটনায় ইয়াছিনের বাবা সুমন শিকদার বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। এর পরই আসামি মাদ্রাসাশিক্ষক রেজাউল করিমকে গ্রেপ্তার করি।
‘আহত ছাত্রকে চিকিৎসার জন্য আমিসহ স্বজনরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসি।’
দেশে বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিশু শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনা নতুন নয়। প্রায়শ মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তুচ্ছ কারণে শিক্ষার্থীদের মারধরের অভিযোগ ওঠে।
শিশু শিক্ষার্থীদের উপর মাদ্রাসা শিক্ষকদের চালানো নির্মম নির্যাতনের একাধিক ভিডিও ফেসবুকে ভাইরালও হয়েছে। একাধিক শিক্ষককে কারাগারেও পাঠিয়েছে আদালত।
গত বছরের মার্চে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় একটি মাদ্রাসায় এক শিশুকে বেদম পিটুনির ভিডিও ভাইরাল হয়। পরে ওই শিক্ষককে আটক করা হয়। এর পরপরই সাতকানিয়ার একটি মাদ্রাসায় চার শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে পেটানো হয়। এই ঘটনায় নাম আসা শিক্ষকেও কারাগারে পাঠানো হয়। গত ১০ আগস্ট ঝালকাঠি সদর উপজেলার একটি মাদ্রাসায় ১০ ছাত্রকে বেত্রাঘাত করেন এক শিক্ষক।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে সারাদেশে এক হাজার ৭৪১টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷ এরমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১২৫টি শিশু৷ এইসব ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে মাত্র আটটি৷ এই সময়ে শিক্ষকদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১৪ জন শিক্ষার্থী৷ ছেলে শিশুরাও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে৷
বাংলাদেশের আইনে ছাত্রদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ৷ ২০১১ সালে হাইকোর্টের এক আদেশের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করে৷ আর তাতে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির সংজ্ঞাও দেয়া হয়েছে৷
শারীরিক শাস্তি বলতে যেকোনো ধরনের দৈহিক আঘাত বলা হয়েছে৷ মারধর ছাড়াও আইনে কান ধরা, চুল টানা, বেঞ্চের নিচে মাথা রাখতে বাধ্য করাও দৈহিক শাস্তি৷ আর মানসিক শাস্তির মধ্যে শিশু বা তার পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বাজে মন্তব্য বা যেকেনো আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি৷
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই দুই ধরনের শাস্তি দেয়াকেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেছে৷ যাদের বিরুদ্ধে এই অপরাধ প্রমাণ হবে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ একই সঙ্গে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে৷
কিন্তু এরপরও বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেয়ার প্রবণতা বেশ লক্ষ্য করা যায়৷ বিশেষ করে মাদ্রাসায় এটা প্রকট৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, মাদ্রাসাগুলোতে প্রায়ই মারধর ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। আর এদের বেশির ভাগই সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ থেকে আসা। সাধারণ শিক্ষার ব্যয় বহন করতে না পেরে অনেক অভিভাবকই সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠিয়ে থাকেন। আবার ধর্মীয় চেতনা থেকেও শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসায় পাঠানো হয়। তাই সমস্যাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করার আগেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৩
আপনার মতামত জানানঃ