প্লাস্টিকের বর্জ্য রিসাইকেল করে তৈরি করা হচ্ছে প্লাস্টিক কুচি। স্থানীয় বিভিন্ন প্লাস্টিক কারখানায় তা সরবরাহের পাশাপাশি রফতানি হচ্ছে বিদেশেও। যশোরসহ আরও কয়েকটি অঞ্চলে এখন প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের এ ব্যবসার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এতে একদিকে যেমন প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণ থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে পরিবেশকে, তেমনি স্থানীয় পর্যায়েও তৈরি হচ্ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ।
জানা যায়, নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার পৌরসভা ও পাঁচটি ইউনিয়নে রয়েছে প্রায় ১১০টি প্লাস্টিক কারখানা। কারখানাগুলোতে মূলত প্লাস্টিকের পুরনো বোতল এবং বিভিন্ন পণ্যে ব্যবহৃত প্লাস্টিক মেশিনে ভেঙে তৈরি করা হয় কুচি। এসব কুচি এখান থেকে সরবরাহ করা হয় দেশের বিভিন্ন বাজারে। প্রতিটি কারখানায় প্রতিদিন ৪০-৫০ শ্রমিক কাজ করেন।
শহরের বাঙালিপুর এলাকার একটি প্লাস্টিক কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে, একদিকে বোতল কিংবা ভাঙা প্লাস্টিক বর্জ্য স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। অন্যদিকে প্লাস্টিক কুচি শুকাতে ব্যস্ত শ্রমিকরা।
উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের অশুরখাই গ্রামের শ্রমিক আতিয়া পারভীন জাতীয় দৈনিক যুগান্তরকে বলেন, স্বামী মারা যাওয়ায় অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতাম। তিন সন্তানকে নিয়ে একবেলা খেয়ে, আরেক বেলা না খেয়ে কোনো রকমে দিন কাটত। কিন্তু এখন প্লাস্টিক বর্জ্য কারখানায় কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা এসেছে।
কথা হয় কারখানার মালিক ইমরান হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, বিভিন্ন ভাঙারির দোকান থেকে তারা প্লাস্টিকের পুরোনো বোতল কেনেন প্রতি কেজি ২০ টাকা দরে। অন্যান্য প্লাস্টিক সামগ্রী কেনেন ৩৫ টাকা কেজি দরে। তারপর এগুলো মেশিনের সাহায্যে পানি দিয়ে ওয়াশ করেন। পরে মাড়াই করে প্লাস্টিকের কুচি মেশিনের মাধ্যমে শুকিয়ে বস্তায় ভরে সরবরাহ করা হয়। প্রতিদিন এ কারখানায় শতাধিক মণ প্লাস্টিক সামগ্রী কেনা হয়।
তিনি আরও বলেন, সরকারি সহযোগিতা পেলে এ শিল্পের আরও প্রসার ঘটানো যেত।
ইলিয়াস হোসেন নামের আরেক প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবসায়ী বলেন, পথে-ঘাটে এবং নালা-নর্দমায় পড়ে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্য কুড়িয়ে এনে এগুলো পরিষ্কার করে আমাদের কাছে বিক্রি করা হয়। পরে সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হয় প্লাস্টিকের গুটি। এরপর নতুন করে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয় নানা পণ্য। এখানে দুই-তিন ধরনের প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা থাকে।
এতে একদিকে যেমন প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণ থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে পরিবেশকে, তেমনি স্থানীয় পর্যায়েও তৈরি হচ্ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ।
পুরো প্রক্রিয়াটি পরিবেশের উপকার করছে দাবি করে তিনি বলেন, কোটি কোটি বোতলসহ প্লাস্টিক বর্জ্য যদি খাল, নদী দখল করত, তা হলে তা পলিথিনের চেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠত।
যশোর শহরের শংকরপুরে গড়ে তোলা এ কারখানায় স্থানীয় বিভিন্ন ভাগাড় থেকে সংগৃহীত প্লাস্টিক রিসাইকেল করা হচ্ছে। কারখানার স্বত্বাধিকারী আশরাফুল হাসান বিপ্লব জানান, ভাঙাড়ির দোকানের স্বল্প পুঁজির আয় দিয়ে তিনি ও তার স্ত্রী কারখানাটি গড়ে তোলেন। পরে তারা স্থানীয় একটি এনজিও থেকে ঋণও নেন। বর্তমানে এ কারখানাকে কেন্দ্র করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষের। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার দাঁড়িয়েছে অন্তত ১০ কোটি টাকায়। সহজ শর্তে মূলধন পেলে নতুন একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন রয়েছে তাদের।
সরেজমিনে ফারদিন প্লাস্টিক অ্যান্ড গ্লাস হাউজের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, কারখানার আঙিনাজুড়ে স্তূপ করে রাখা হয়েছে প্লাস্টিক বর্জ্য। কর্মীরা প্লাস্টিকের বোতল বাছাই ও পরিষ্কারের পর তা টুকরো টুকরো করছেন মেশিনে। আরেকটি যন্ত্রের সাহায্যে রাসায়নিক মিশ্রিত পানি দিয়ে সে টুকরো ধোয়া হচ্ছে। পরে অন্য একটি যন্ত্রের মধ্যে শুকানো হচ্ছে এসব ভেজা টুকরো।
পরিবেশ অধিদপ্তর রংপুরের পরিদর্শক (নীলফামারী জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত) মনোয়ার হোসেন বলেন, যত্রতত্র পড়ে থাকা প্লাস্টিক দ্রব্য পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। এ ক্ষেত্রে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক প্রক্রিয়াজাত করায় পরিবেশ দূষণের হাত থেকে এ এলাকা রক্ষা পাচ্ছে।
সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম হুসাইন বলেন, এ শিল্পের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে যদি তা পরিবেশের জন্য ইতিবাচক হয়, তা হলে সহযোগিতার বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, পরিবেশ দূষণকারী প্লাস্টিক বোতল থেকে কুচি বানিয়ে বিদেশে রফতানির এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এসব উদ্যোগকে আরো কাজে লাগাতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এতে একদিকে যেমন মানুষের কর্মসংস্থান হবে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও বাড়বে।
তারা বলেন, প্লাস্টিক বোতল এমনিতে পরিবেশের জন্য হুমকি। সেটি মেশিনে রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে প্লাস্টিক কুচি তৈরি হচ্ছে। এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। এতে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা হচ্ছে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ছে। এ উদ্যোগ কেন্দ্রীয়ভাবে বড় পরিসরে নেয়া প্রয়োজন। তাহলে প্লাস্টিকে আর পরিবেশ নষ্ট হবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৫
আপনার মতামত জানানঃ