প্লাস্টিক পুরো বিশ্বেই বহুল ব্যবহৃত একটি সামগ্রী। প্লাস্টিকের গামলা, বালতি, চায়ের কাপ, স্ট্র, পানির বোতল, কোমল পানীয়ের পাত্র ইত্যাদি রান্নাঘরের কোণ থেকে শুরু করে ঘর-গৃহস্থালির সব জায়গাতেই ব্যবহার হয়। এমনকি জুস কিংবা চা সরবরাহের জন্য হোটেলগুলোতে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার হয়ে থাকে।
অনেকেই বাসাবাড়িতে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য রাখার ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহার করে থাকেন। অপেক্ষাকৃত সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ায় প্রতিদিন আমরা নানাভাবে প্লাস্টিকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছি।
বিশেষ করে ওয়ান-টাইম ইউজ প্লাস্টিক (বোতল, কাপ, প্লেট, বক্স, চামচ, স্ট্র) দ্রব্যের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। মাছ-মাংস, শাক-সবজি, ডাল, চিনি, রসগোল্লা ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য শোভা পাচ্ছে প্লাস্টিকের মোড়কে।
আকার ও ওজনে সুবিধাজনক হলেও প্লাস্টিকের বোতল স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তা সত্ত্বেও প্লাস্টিকের বোতলে শুধু পানি, তেল, সস, বা জুস নয়, ওষুধ পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হয় যে, এটা প্লাস্টিকের যুগ।
অথচ বিশ্বের প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজন ব্যক্তি একবার ব্যবহারযোগ্য বা সিঙ্গেল টাইম প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার পক্ষে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত একটি জরিপ বলছে, জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো প্লাস্টিক দূষণের ক্রমবর্ধমান হারে লাগাম টানতে একটি বৈশ্বিক চুক্তির বিষয়ে আলোচনা শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিশ্বের ২৮টি দেশের ২০ হাজারেরও বেশি মানুষের ওপর চালানো আইপিএসওএস জরিপ অনুসারে, প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করতে চায় এমন মানুষের সংখ্যা ২০১৯ সালের চেয়ে ৭১% বেড়েছে। একই সঙ্গে, কম প্লাস্টিকের প্যাকেজিংসহ পণ্য পেতে চান এমন মানুষের হার ৭৫% থেকে বেড়ে ৮২% হয়েছে।
অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, ফলাফলগুলো প্লাস্টিক বর্জ্য মোকাবিলার ক্ষেত্রে নাইরোবিতে আসন্ন আন্তর্জাতিক বৈঠকে একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠাচ্ছে।
ডব্লিউডব্লিউএফ ইন্টারন্যাশনালের মহাপরিচালক মার্কো ল্যাম্বার্টিনি বললেন, ‘বিশ্বব্যাপী মানুষ তাদের মতামত স্পষ্ট করছে। ফলে, বিশ্বব্যাপী একটি প্লাস্টিক ব্যবহার সংক্রান্ত চুক্তির দায়িত্ব ও সুযোগ এখন সরকারগুলোর হাতে’।
সমীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রায় ৯০% মানুষ বলেছেন, তারা এমন একটি চুক্তির পক্ষে। কিন্তু এ ধরনের কোনো চুক্তি বর্জ্য সংগ্রহ এবং পুনর্ব্যবহারে ফোকাস করা বা উৎপাদন ও ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের ব্যবহার রোধ করার মতো পদক্ষেপ নেবে কি-না তা দেখার বিষয়।
প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করতে চায় এমন মানুষের সংখ্যা ২০১৯ সালের চেয়ে ৭১% বেড়েছে। একই সঙ্গে, কম প্লাস্টিকের প্যাকেজিংসহ পণ্য পেতে চান এমন মানুষের হার ৭৫% থেকে বেড়ে ৮২% হয়েছে।
রয়টার্স গত সপ্তাহে জানিয়েছে, বড় বড় তেল এবং রাসায়নিক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের প্লাস্টিকের উৎপাদন সীমিত করবে, এমন কোনো চুক্তি যেন করা না হয় সে বিষয়ে পরিকল্পনা করছে।
জাতিসংঘ প্লাস্টিক দূষণ বন্ধের চুক্তিতে একমত হতে না পারলে আগামী কয়েক দশকে ব্যাপক পরিবেশগত ক্ষতি হবে। যার ফলে কিছু সামুদ্রিক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং প্রবাল প্রাচীর ও ম্যানগ্রোভের মতো সংবেদনশীল বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবে।
যেকোনো চুক্তি চূড়ান্ত হতে কমপক্ষে দুই বছর সময় লাগতে পারে। তাই, আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত নাইরোবিতে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে চুক্তির মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হবে।
জরিপে একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক নিষেধাজ্ঞার জন্য সবচেয়ে বড় সমর্থন এসেছে কলম্বিয়া, মেক্সিকো ও ভারতের মতো তীব্র বর্জ্য সংকটে থাকা দেশগুলো থেকে।
আইপিএসওএস পোল থেকে আরও জানা গেছে, বিশ্বব্যাপী জরিপে অংশ নেওয়ার উত্তরদাতাদের ৮৫%-ই চান প্লাস্টিক প্যাকেজিং হ্রাস এবং পুনর্ব্যবহার করার জন্য নির্মাতা ও খুচরা বিক্রেতাদের দায়ী করা হোক।
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা, যা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকে একটি একক পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের একাধিক কারণ আমাদের সামনে দণ্ডায়মান। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে এটি যতটা না প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট, তার থেকেও বেশি মানবসৃষ্ট। মানবসৃষ্ট একাধিক কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে প্লাস্টিক।
প্লাস্টিক হলো সিনথেটিক বা সেমি-সিনথেটিক ও নিম্ন গলনাঙ্কবিশিষ্ট পদার্থ, যা তাপীয় অবস্থায় যেকোনো আকার ধারণ করতে পারে এবং পুনরায় কঠিনে রূপান্তরিত হতে পারে। প্লাস্টিক স্থায়ী, সহজলভ্য, সস্তা এবং সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় আমরা সবাই প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল এমনকি উন্নত দেশেও প্লাস্টিক একটি নিত্য ব্যবহার্য বস্তু। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য প্লাস্টিক চাহিদা ব্যাপক। দিনের পর দিন প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে।
প্লাস্টিক মাটি ও পানিতে ফেললে পচে না, গলেও না। প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার শেষে মাটি কিংবা পানিতে ফেলে দেয়ার পর তা থেকে যায় অনন্তকাল। প্লাস্টিকদ্রব্য এবং এর উপজাত, কণিকা বা নিঃসরিত অণুর সংযোজন জল ও স্থলে মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান ছড়ায়। এর ফলে মানুষসহ পুরো জীবজগত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, মাটি ও পানিতে খাদ্যচক্রের প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিক নিঃসৃত ভয়াবহ ক্ষতিকর পদার্থও মিশে যায়, যা খেয়ে মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণী এমনকি উদ্ভিদও নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, এর বিরূপ প্রভাবে মানবদেহে ক্যান্সার, এ্যাজমা, অটিজম, হরমোনজনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি হয়। পরিবেশবিদদের মতে, প্লাস্টিক দূষণ ইকোসিস্টেমের (বাস্তুতন্ত্র) জন্য অশনি সঙ্কেত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে মানুষসহ সমগ্র জীবজগত। তাই প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক না হলে রয়েছে মহা বিপদের শঙ্কা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্লাস্টিকের পাত্রে কিছু রেখে খাওয়া এবং প্লাস্টিকের বোতলে পানি পান করা ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। প্লাস্টিকের বোতলে থাকা রাসায়নিক পদার্থ খাবারের মধ্যে চলে যায়। এটি খাবার থেকে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে। শুধু তাই নয়, প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার গরম করলে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান বের হয়ে খাবারের মধ্যে প্রবেশ করে। এর ফলে ক্রমাগত বাড়ছে ক্যান্সার, অ্যাজমা, অটিজম, হরমোনজনিত সমস্যা, গর্ভপাতসহ নানা জটিল রোগ। এসব সামগ্রীর সংস্পর্শে প্রতিবছর আনুমানিক এক লাখ বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের গবেষণা রিপোর্ট অনুসারে, সারাবিশ্বে প্রতি বছর ১৬ কোটি ৫০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে পতিত হয়। সাগর থেকে মহাসাগর পর্যন্ত পতিত হয় বছরে অন্তত ১০ কোটি টন। যার ৮৫ শতাংশই ভূমি উৎস থেকে পতিত হয়। সাগরে বর্তমানে ৫ দশমিক ২৫ ট্রিলিয়ন মাইক্রো ও ম্যাক্রো প্লাস্টিকের কণা জমা রয়েছে।
এভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে সাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক কণার সংখ্যা বেশি হবে। বর্তমানে প্রতি বর্গমাইল সমুদ্রে ৫০ হাজার প্লাস্টিক টুকরা জমা রয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে হিমালয় পর্বতও রক্ষা পাচ্ছে না। এর ক্ষতি থেকে কোন দেশ বা অঞ্চলই রক্ষা পাচ্ছে না। যেসব দেশ প্লাস্টিক পণ্য বেশি উৎপাদন বা ব্যবহার করে তারা এবং যেসব দেশ উৎপাদন ও ব্যবহার কম করে তারাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রেহাই পায় না।
এক সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্লাস্টিক উৎপাদনে বছরে ব্যবহার হয় ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল। এক আউন্স পরিমাণ প্লাস্টিক বা পলিথিন প্রস্তুত করতে পাঁচ আউন্স কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুতে নির্গত হয়। এতে ব্যাপক গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া হয়। এ ছাড়া প্লাস্টিক থেকে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরিবেশবিদরা কিছুটা সোচ্চার হওয়ায় প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার নিয়ে সারাবিশ্বেই ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও ব্যবহার বন্ধে আন্দোলনও হচ্ছে। তবে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কিছুটা বাড়ছে। যথাযথ আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগ করে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার হঠাৎ করেই বন্ধ করা যাবে না। তবে প্লাস্টিক রিসাইকেল উপযোগী করা গেলে অনেক কম ক্ষতিকারক হবে। কারণ, এই বর্জ্য রিসাইকেল করে পুনরায় ব্যবহার করা যাবে। এর ফলে পরিত্যক্ত অবস্থায় যেখানে-সেখানে আর প্লাস্টিক পণ্য পড়ে থাকবে না। আর তা হলে প্লাস্টিক বর্জ্য মাটি ও পানির সঙ্গে মিশে পরিবেশের ক্ষতি করতে পারবে না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিতে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের ওপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা পালনে দেশের জনগণকে সম্পৃক্ত করা দরকার।
তারা বলেন, সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ প্রশাসন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সততা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এবং জবাবদিহিতার অভাব ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে বর্তমানে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। একইসঙ্গে রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলা।
তারা বলেন, ‘আগামী বছরগুলোতে প্লাস্টিকের ব্যবহার কি বাড়বে? আমরা অনায়াসে বলতে পারি বাড়বে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে হাত মিলিয়েই বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। তারা বলেন, অর্থনীতিতে যত বেশি প্রবৃদ্ধি আসছে প্লাস্টিকের ব্যবহারও বাড়ছে। প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে নির্মাণে, অবকাঠামো উন্নয়নে, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস শিল্পে এবং পরিবহনে।
তারা বলেন, আপনার ছোট ছোট পদক্ষেপে সমুদ্র দূষণ কমতে পারে। সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং চারপাশের মানুষকেও সমুদ্রের গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে হবে। সমুদ্রে বেড়াতে গেলে আমরা জেনে বা না বুঝে বিভিন্ন খাবারের প্যাকেটসহ বোতল বা প্লাস্টিক ইত্যাদি পানিতে ফেলে দূষিত করি। এবিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৬
আপনার মতামত জানানঃ