নিউক্লিয়ার ফিউশন নামের যে প্রক্রিয়ায় সূর্যের মত নক্ষত্রে শক্তি তৈরি হয়, পৃথিবীতে সেই প্রক্রিয়া উদ্ভাবনের চেষ্টায় বড় ধরনের সাফল্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ইউরোপীয় গবেষকরা।
তারা জানিয়েছেন, ফিউশন বিক্রিয়া ব্যবহার করে অপেক্ষাকৃত কম দামে ও পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদনের নতুন রেকর্ড করছেন তারা।
যুক্তরাজ্যের অ্যাটমিক এনার্জি অথরিটি বুধবার এক ঘোষণায় জানিয়েছে, ২০২১ সালের জুন মাসে জেইটি রিঅ্যাক্টরে এক পরীক্ষা চলার সময়ে রিঅ্যাক্টর থেকে ৫৯ মেগাজুল শক্তি উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়েছে, যা শক্তি উৎপাদনের ১৯৯৭ সালে করা এই প্রতিষ্ঠানটির রেকর্ডের দ্বিগুণ।
এএফপির খবরে বলা হয়েছে, এই ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে মূলত সূর্যে তাপ উৎপাদিত হয়। এ ছাড়া যে মৌলিক পদার্থ ব্যবহার করে এই বিক্রিয়া ঘটানো হয়, তা অন্য পদার্থে পরিণত হয়।
বলা হচ্ছে, নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব হলে তা হবে পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ। এ ছাড়া শক্তির বিপুল উৎস হতে পারে এই নিয়ন্ত্রিত নিউক্লিয়ার ফিউশন। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, অদূরভবিষ্যতে শক্তির উৎস হিসেবে এটি ব্যবহার করা যাবে।
নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপাদনে মূলত হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটোপ ডিউটেরিয়াম, ট্রিটিয়াম ব্যবহার করা হয়। নিয়ন্ত্রিত বিক্রিয়ায় এই হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিণত হয় এবং নিউক্লিয়াস থেকে নিউট্রন নির্গত হয়। এই নিউট্রনকে তাপ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়।
এই পদ্ধতির সফল পরীক্ষা চালানো হয়েছে যুক্তরাজ্যে। সেখানে এই প্রক্রিয়ায় প্লাজমা তৈরি করা হয়েছে। এ জন্য সূর্যের কেন্দ্রে যে পরিমাণ তাপমাত্রা থাকে, তার যে চেয়ে ১০ গুণ তাপমাত্রায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই পরীক্ষায় ফলাফল পাওয়া গেছে তা থেকে এটা স্পষ্ট যে ফিউশন বিক্রিয়া নিরাপদ ও টেকসই (কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কম) শক্তি উৎস হতে পারে।
বিবিসি লিখেছে, সত্যি সত্যি যদি পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটানো যায়, তার মধ্য দিয়ে দৃশ্যত অসীম পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করা যাবে পরিবেশবান্ধব উপায়ে। এ প্রক্রিয়ায় কার্বন নির্গামন বা তিজস্ক্রিয় নিঃসরণের ঝুঁকিও তেমন বাড়বে না।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এবারের গবেষণায় যে পরিমাণ শক্তি তৈরি করা গেছে, তা দিয়ে ৬০ কেটলি পানি গরম করা যাবে। সেই অর্থে এটা অনেক বড় পরিমাণ শক্তি হয়ত নয়, তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বিজ্ঞানীরা একটি কৌশল উদ্ভাবন করতে পেরেছেন, যা দিয়ে আরও বড় আকারের ফিউশন রিঅ্যাক্টর তৈরি করা যাবে।
রিঅ্যাক্টর ল্যাবের হেড অব অপারেশনস ড. জো মিলনেস বলেন, ‘জেইটির এই গবেষণা আমাদের ফিউশন পাওয়ারের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিল। এ গবেষণায় আমরা এটাই দেখাতে পেরেছি যে, আমাদের যন্ত্রের মধ্যে আমরা অতি ক্ষুদ্র একটি নক্ষত্রের জন্ম দিতে পেরেছি এবং ৫ মিনিট সেটাকে ধরে রাখতে পেরেছি। এখানে যে পারফরম্যান্স আমরা দেখাতে পেরেছি, তা আমাদের পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাবে’।
সত্যি সত্যি যদি পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটানো যায়, তার মধ্য দিয়ে দৃশ্যত অসীম পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করা যাবে পরিবেশবান্ধব উপায়ে। এ প্রক্রিয়ায় কার্বন নির্গামন বা তিজস্ক্রিয় নিঃসরণের ঝুঁকিও তেমন বাড়বে না।
জেইটি ল্যাবরেটরির এ গবেষণা চলছে ইন্টারন্যাশনাল থার্মোনিউক্লিয়ার এক্সপেরিমেন্টাল রিঅ্যাক্টরের (আইটিইআর) কর্মসূচির অধীনে। দক্ষিণ ফ্রান্সে ওই নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের গবেষণা এগিয়ে নিতে সমর্থন দিচ্ছে বেশ কয়েকটি দেশের একটি কনসোর্টিয়াম, যার মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনও রয়েছে।
বিবিসি লিখেছে, এই শতকের দ্বিতীয় ভাগেই নিউক্লিয়ার ফিউশন একটি নির্ভরযোগ্য জ্বালানি উৎস হয়ে উঠতে পারে, এই গবেষণার সাফল্য হয়ত সেটাই প্রমাণ করল।
ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদুৎকেন্দ্র তৈরি করলে তাতে গ্রিনহাউস গাস নির্গমণ হবে না। স্বল্পস্থায়ী তিজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হলেও তার পরিমাণ হবে খুবই সামান্য।
জেইটি ল্যাবরেটরির সিইও অধাপক ইয়ান চ্যাপমান বলেন, ‘যে গবেষণা আমরা শেষ করলাম, তা বাস্তবেও কাজ করার কথা। যদি তা কাজ না করে, তাহলে আইটিইআর লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন উঠবে’।
আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির বিজ্ঞানমন্ত্রী জর্জ ফ্রিম্যানও ‘মাইলফলক’ ফলাফলকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাজ্য তার ইউরোপীয় অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে ফিউশন প্রযুক্তিতে গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে একে বাস্তবে রূপ দান করছে।’
নিউক্লিয়ার ফিউশন এমন এক প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ায় সূর্য তাপ উৎপন্ন করে থাকে। ধারণা করা হয়, এই প্রকল্পের মাধ্যমে একদিন বিশ্বব্যাপী দূষণমুক্ত ও নিরাপদ শক্তি সরবরাহ করবে, যার ফলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা সহজ হবে।
ফসিল ফুয়েলকেন্দ্রিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ ছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানিও অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করতে পারে না। আর প্রচলিত নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরে সৃষ্ট নিউক্লীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজও ব্যয়বহুল ও দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ। সেই হিসাবে ফিউশন রিঅ্যাক্টরে পরিবেশ দূষণ কিংবা নিউক্লীয় বর্জ্যের কোনো ঝামেলা নেই।
প্রচলিত নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর কাজ করে ফিশন প্রক্রিয়ায়। যেখানে একটি ভারী নিউক্লিয়াসকে একটি নিউট্রন দ্বারা আঘাত করলে এটি বিভক্ত হয়ে দুটি হালকা নিউক্লিয়াস এবং প্রায় দুই শ মেগা-ইলেকট্রনভোল্ট শক্তি নির্গত করে।
অপরদিকে ফিউশন প্রক্রিয়ায় দুটি হালকা নিউক্লিয়াস একত্রিত হয়ে একটি ততোধিক ভারী নিউক্লিয়াস গঠন করে এবং শক্তি নির্গত করে। মূলত সূর্যে এ ধরনের বিক্রিয়ায় শক্তি উৎপন্ন হয়। এ ধরনের প্রযুক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে সূর্যের বিক্রিয়াকেই অনুকরণ করতে হয়। তাই এ ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলে সেটাকে ‘কৃত্রিম সূর্য’ বলা হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১৭
আপনার মতামত জানানঃ