আজকাল অনেক কমবয়সি মানুষেরও হৃদরোগ হচ্ছে৷ চিকিৎসার অগ্রগতির ফলে তাদের সহায়তা করাও অনেক সহজ হয়ে পড়েছে৷ কিন্তু হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে গেলে অঙ্গ প্রতিস্থাপন ছাড়া উপায় নেই৷ এক কৃত্রিম হৃদযন্ত্র অনেকের প্রাণ বাঁচাতে পারে৷
বয়স যত বাড়ে, শরীরের কলকব্জাও বিকল হতে থাকে৷ স্বাভাবিক এ নিয়মে অনেক প্রবীণেরই হৃদযন্ত্র ঠিকভাবে কাজ করে না৷ বিশেষ করে যার মাধ্যমে সারা দেহে রক্ত সঞ্চালনের কাজটি হয় বলে মানুষ বেঁচে থাকে, হৃদযন্ত্রের সেই পাম্প নষ্ট হয়ে যায় অনেকেরই৷ সেক্ষেত্রে কেউ দান করলেই সমস্যার সমাধান৷ তো এভাবে হৃদযন্ত্রের প্রতিস্থাপনেও দেখা দিয়েছে সমস্যা৷ চাহিদা বাড়ছে, কিন্তু সেই অনুপাতে সরবরাহ বাড়ছে না৷ অঙ্গ দান করার লোক বাড়ছে না, সরবরাহ বাড়বে কি করে? এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে কৃত্রিম পাম্পের দিকে ঝুঁকছেন সবাই৷
ফরাসি প্রতিষ্ঠান কারমাত ‘এসন’ ব্র্যান্ড নামে কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড উৎপাদন এবং তা মানবদেহে প্রতিস্থাপন করতে শুরু করেছে। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ইউরোপীয় দেশগুলোর অনুমোদন লাভের পরপরই তা শুরু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মানবদেহে প্রতিস্থাপনের পর কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড খুব ভালো কাজ করছে। এমনকি বিশ্রাম, ব্যায়াম, ভারী কাজ করার সময় আসল হৃৎপিণ্ডের মতোই সাড়া দিচ্ছে। অর্থাৎ হৃৎস্পন্দন কম-বেশি হওয়াতে আসল হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে প্রায় কোনো পার্থক্য নেই।
আকারে (৭৫০ মিলিলিটার) এবং ওজনে ততটা বেশি না হওয়ায় এসন কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। তা ছাড়া যেসব উপাদানে এমন হৃৎপিণ্ড তৈরি করা হয়েছে, তা জৈব সামঞ্জস্যপূর্ণ। অর্থাৎ দেহকোষের সঙ্গে অনেকটা সহজেই মানিয়ে নিতে পারে এবং সংক্রমণের ভয় নেই।
দাতার অভাবে হৃৎপিণ্ড পেতে বেশ দেরি হয়ে যায়। ফলে যেসব রোগীর হৃদ্যন্ত্র একেবারেই কাজ করছে না, তাদের দেহে এই কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করে অপেক্ষাকালীন ১৮০ দিন, অর্থাৎ ছয় মাস পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। এই হৃৎপিণ্ডের কল্যাণে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সময় একজন রোগী দুই বছরেরও বেশি সময় বেঁচে ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, এক ইউরোপেই প্রতিবছর ২ হাজার মানুষের জীবন বাঁচাবে এই কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড।
মানুষের তৈরি হৃৎপিণ্ডের মূল অংশ হলো দুটি খুব ছোট পাম্পিং ইউনিট, যেটি পুরোপুরি মানুষের হৃদ্যন্ত্রের বিকল্প হিসেবে নিঃশব্দে কাজ করে। রোগীর চলাফেরা ও স্বাভাবিক কাজকর্মে যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রেখেই দেহের বাইরে ব্যাটারি এবং অন্যান্য সরঞ্জামসহ একটি চার কেজি ওজনের ব্যাগ যুক্ত করা হয়েছে। এসব সরঞ্জাম হৃদ্যন্ত্রটি সঠিক কাজকর্ম করছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখে ও ত্রুটি দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়ে দেয়।
জার্মানিতেও তৈরি হচ্ছে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম কৃত্রিম হৃদযন্ত্র৷ কোনো রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই বহু বছর ধরে সেটি চালু থাকে, কোনো তার না থাকায় সংক্রমণের ভয়ও নেই৷ অদূর ভবিষ্যতে এটি বাজারে এলে সারা বিশ্বে হাজার হাজার রোগী নতুন জীবন পেতে পারেন৷ কারণ সে ক্ষেত্রে তাদের আর কারো অঙ্গদানের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না৷
ফরাসি প্রতিষ্ঠান কারমাত ‘এসন’ ব্র্যান্ড নামে কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড উৎপাদন এবং তা মানবদেহে প্রতিস্থাপন করতে শুরু করেছে। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ইউরোপীয় দেশগুলোর অনুমোদন লাভের পরপরই তা শুরু হয়েছে।
জার্মানির আখেন শহরের প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আরডাব্লিউটিএইচ-এর অধ্যাপক উলরিশ স্টাইনসাইফার ও তার টিম নতুন এই কৃত্রিম হৃদযন্ত্র তৈরি করেছেন৷ সেই ১৯৯০-এর দশক থেকেই ইনস্টিটিউট অফ অ্যাপ্লায়েড মেডিকাল টেকনোলজি-তে কৃত্রিম হৃদযন্ত্র নিয়ে কাজ চলছে৷ বিজ্ঞানীরা এবার সেই হৃদযন্ত্র এত ছোট করতে পেরেছেন, যাতে আরও বেশি মানুষের শরীরে তা ইমপ্লান্ট করা যায়৷
এর মূল অংশ হলো একটি পাম্পিং ইউনিট, যেটি পুরোপুরি মানুষের হৃদযন্ত্রের বিকল্পের কাজ করে৷ সেটি চালায় এমন এক ইঞ্জিন, যা একটি মাত্র অংশ দিয়ে তৈরি এবং যেটি সহজেই চৌম্বক ক্ষেত্রে নড়াচড়া করতে পারে৷ আরডাব্লিউটিএইচ আখেন-এর ফেলিক্স গ্রেফ বলেন, ‘এখানে কয়েল দেখতে পাচ্ছি, পেঁচানো কয়েল, আর এখানে কালো চুম্বকগুলি৷ কয়েলে বিদ্যুত চলাচল শুরু হলে পেন্ডুলামের মতো নড়াচড়া শুরু হয়৷ ফলে হৃদপিণ্ডের বাম ও ডান চেম্বারের ভেন্ট্রিকল বা নিলয় খালি হয় এবং শরীরে রক্তের চলাচল সৃষ্টি হয়’৷
কোনো তার ছাড়াই শুধু ত্বকের মাধ্যমে কৃত্রিম হৃদযন্ত্রে বিদ্যুৎ পাঠানো হয়৷ ত্বকের নীচে তার না থাকায় সংক্রমণও ঘটে না৷ রোগীর বেল্টে ব্যাটারি বসানো থাকায় হাঁটাচলার ক্ষেত্রেও আর তেমন কোনো বাধা থাকে না৷ অধ্যাপক স্টাইনসাইফার বলেন, ‘এখান থেকে কৃত্রিম হৃদযন্ত্রে শক্তি পাঠাতে হয়৷ সমস্যা হলো ত্বকের মাধ্যমে তা প্রেরণ করা৷ আমরা এ ক্ষেত্রে ‘ইন্ডাকটিভ কাপলিং’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই কাজ করছি৷ দুটি কয়েল-এর মধ্যে একটি ইমপ্লান্ট করা রয়েছে৷ অন্যটি বাইরে থাকে৷ ‘ইন্ডাকশন’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি পাঠানো হয়৷ এটা সহজেই দেখানো যায়৷ একটি এলিমেন্ট কাছে আনলেই ডায়ড জ্বলে ওঠে৷ অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ‘ইন্ডাকটিভ’ প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ পাঠানো হচ্ছে’৷
বর্তমানে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সময় পর্যন্ত রোগীর জন্য কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড ব্যবহার করা হয়৷ কিন্তু জার্মান গবেষকরা স্থায়ীভাবে কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড ব্যবহার সম্ভব করতে চান৷ এখনো পর্যন্ত পরীক্ষায় প্রটোটাইপগুলি পাঁচ বছর পর্যন্ত ব্যবহারের উপযোগী বলে প্রমাণ করা গেছে৷ এই সময়কালে ২০,০০০ কোটিরও বেশি হৃৎস্পন্দন ঘটে৷ মেরামতি বা ব্যাটারি বদলানোর কোনো প্রয়োজন পড়েনি৷
হৃৎপিণ্ডের চেম্বারদুটির মধ্যে ‘ফ্লো’ এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ রক্ত অতি দ্রুত বা অতি ধীরে চলাচল করলে চলবে না৷ অন্যথায় চেম্বারের ক্ষতি হতে পারে৷ কম্পিউটার সফটওয়্যারের মাধ্যমে গবেষকরা রক্তের প্রতিক্রিয়া সিমুলেট করছেন৷ রক্তের সারফেস ও গতিবিধি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা হয়৷ অধ্যাপক স্টাইনসাইফার বলেন, ‘আমরা আমাদের কৃত্রিম হৃদযন্ত্রে শুধু ‘অপটিমাইজড সারফেস’ ও উপকরণ ব্যবহার করেছি, যা রক্ত বহনের জন্য বেশ উপযুক্ত৷ এছাড়া পাম্পিং চেম্বারে রক্ত চলাচলের আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে’৷
এদিকে সুইজারল্যান্ডের ইটিএইচ জুরিখ কেন্দ্রে দীর্ঘদিনের গবেষণার পর থ্রিডি প্রিন্টারে নরম সিলিকন দিয়ে কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড তৈরি করা হয়েছে, যা মানুষের আসল হৃদযন্ত্রের মতোই কাজ করছে বলে দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা জানান, ধাতু ও প্লাস্টিকের তৈরি পাম্পের মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের বিকল্প হিসেবে যা ভাবা হয়েছিল, তার চেয়ে সিলিকনের তৈরি হৃদযন্ত্র অনেক বেশি কার্যকরী। ঠিক মানুষের রক্ত-মাংসের হৃদযন্ত্রের মতোই এটি কাজ করবে। আসল হৃদযন্ত্রের মতো এতে দুটি অলিন্দ রয়েছে। তবে বিভাজিকার বদলে রয়েছে দুটি আলাদা প্রকোষ্ঠ। যার একটি প্রকোষ্ঠের মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবেশ করতে পারে এবং অন্যটির মধ্য দিয়ে তা পাম্প হয়ে বেরিয়ে যেতে পারে।
বিজ্ঞানীরা আরো জানান, এ সিলিকন হৃদযন্ত্র তিন হাজার বার বিট করতে পারছে। এরপরই অবশ্য এর কাজ সমাপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এ সিলিকন হৃদযন্ত্রের সহায়তায় একজন মানুষ ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট বেঁচে থাকতে পারবে। তবে গবেষকরা এখন এমন এক পদার্থের খোঁজ চালাচ্ছেন যা আসল হৃদযন্ত্রের মতোই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে।
পুরো পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যুর জন্য যতগুলো কারণ আছে, সবগুলো কারণের শীর্ষে আছে হৃদ্রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে হৃদ্রোগের কারণে প্রতিবছর অকালে প্রাণ হারায় প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। অনেকেই তাই হৃদ্রোগকে ‘অসংক্রামক অতিমারি’ আখ্যা দিয়েছেন। হৃদ্যন্ত্র বিকল হয়ে গেলে অঙ্গ প্রতিস্থাপন ছাড়া উপায় নেই। আর তাই কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড আশার আলো দেখাচ্ছে। গবেষক ও বিশেষেজ্ঞরা নিশ্চিত যে কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড বাঁচাবে বহু প্রাণ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ