ইউক্রেন সংকট বিশ্বের জ্বালানি নিরাপত্তা বড় প্রশ্নের মুখে ফেলেছে৷ বিকল্প উৎস ও প্রযুক্তির সন্ধান জোরকদমে চলছে৷ এই অবস্থায় একটি প্রকল্পকে ঘিরে প্রত্যাশা আরও বেড়ে গেছে৷
সূর্য আমাদের জ্বালানি সংক্রান্ত সব সমস্যার সমাধান হতে পারে৷ সেটি আসলে বিশাল এক চুল্লির মতো, যার মধ্যে পারমাণবিক ফিউশন হয়ে চলেছে৷ দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তপমাত্রা ও প্রবল চাপের মধ্যে হাইড্রোজেন পরমাণু হিলিয়ামে ফিউজ হয়ে চলেছে, যার ফলে অকল্পনীয় পরিমাণ শক্তি বার হয়ে আসছে৷
পৃথিবীর বুকেই সূর্যের পারমাণবিক ফিউশন নকল করার তোড়জোড় চলছে৷ এই থার্মোনিউক্লিয়র চুল্লির মধ্যে কৃত্রিম সূর্য সৃষ্টি করা হচ্ছে৷ কৃত্রিম সূর্য সৃষ্টিতে ইউরোপ চীনের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পরমাণু জ্বালানির জন্য কৃত্রিম সূর্য আবিষ্কার করেছে দক্ষিণ কোরিয়া।
সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং দ্য কোরিয়া ইনস্টিটিউট ফর ফিউশন এনার্জি মিলে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর এই সূর্য আবিষ্কার করেছে। চীনের তৈরি কৃত্রিম সূর্যের চেয়েও দক্ষিণ কোরিয়ার সূর্যের শক্তি বেশি। কোরিয়া সুপারকন্ডাক্টিং তোকামাক অ্যাডভান্সড রিসার্চ রিঅ্যাক্টরে (কেএসটিএআর) এই সূর্য তৈরি করা হয়েছে। মূলত কেএসটিএআরকেই কৃত্রিম সূর্য বলা হচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও কোরিয়া ইনস্টিটিউট অব ফিউশন এনার্জির বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, কোরিয়া সুপারকন্ডাক্টিং তোকামাক অ্যাডভান্সড রিসার্চ (কেএসটিএআর) নামে একটি পারমাণবিক চুল্লি (রিঅ্যাক্টর) ৩০ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে ১০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় পৌঁছায়। এটা মাইলফলক, যা প্রথমবারের মতো এমন ঘটনা ঘটেছে।
কেএসটিএআর পারমাণবিক চুল্লি উত্তপ্ত হয়ে অত্যধিক তাপমাত্রা সৃষ্টির ঘটনার একটি ভিডিও গত শুক্রবার ইউটিউবে শেয়ার করা হয়। ‘সায়েন্স অ্যালার্ট’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে এটি আপলোড করা হয়েছে।
ভিডিওটির ক্যাপশনে বলা হয়েছে, কেএসটিএআর চুল্লিটি ২৪ সেকেন্ডের মধ্যে এই আয়ন তাপমাত্রা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। চ্যানেলের তথ্যে আরও বলা হয়েছে, কোরিয়ার কেএসটিএআর চুল্লিটি ২০ সেকেন্ডের বেশি সময় ধরে ১০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্লাজমা ধরে রেখেছে। প্লাজমা হলো অতি উচ্চ তাপমাত্রায় আয়নিত গ্যাস। গবেষকেরা শব্দের মধ্য দিয়ে এ প্লাজমাকে শনাক্ত করতে পারেন।
কৃত্রিম সূর্য তৈরি হলে তা আমাদের পুড়িয়ে মারবে না। বরং এ থেকে অফুরন্ত তাপশক্তি আমরা নিরাপদে ব্যবহার করতে পারব। এটা তৈরির কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হলে বিদ্যুতের জন্য জ্বালানি তেল কয়লা পোড়ানো ন্যূনতম মাত্রায় নামিয়ে আনা এবং কার্বনমুক্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার সহজ হবে।
নিউইয়র্ক পোস্ট-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, আসল সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে তাপ উৎপাদনের মতোই তাপমাত্রা পেতে এর প্রক্রিয়াকে কৃত্রিমভাবে প্রয়োগের চেষ্টা করছেন। এ বছরের শেষ নাগাদ ১০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ৫০ সেকেন্ড ধরে রাখতে চান বিজ্ঞানীরা। ২০২৬ সাল নাগাদ তাদের লক্ষ্য হচ্ছে কৃত্রিম সূর্যের তাপমাত্রা ৩০০ সেকেন্ড বা ৫ মিনিট পর্যন্ত ধরে রাখা। ধীরে ধীরে তা বাড়ানো, যাতে করে পরিবেশবান্ধব শক্তি পাওয়া যেতে পারে। এতে করে জ্বালানিসংকটও দূর করা সম্ভব হবে বলে বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় জানিয়েছেন।
কৃত্রিম সূর্য তৈরি হলে তা আমাদের পুড়িয়ে মারবে না। বরং এ থেকে অফুরন্ত তাপশক্তি আমরা নিরাপদে ব্যবহার করতে পারব। এটা তৈরির কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হলে বিদ্যুতের জন্য জ্বালানি তেল কয়লা পোড়ানো ন্যূনতম মাত্রায় নামিয়ে আনা এবং কার্বনমুক্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার সহজ হবে।
সূর্যের ভেতরে ফিউশন রিঅ্যাকশনে যে প্রচণ্ড তাপশক্তি তৈরি হয়, আয়ন সম্মিলিত হওয়ার সময় প্রচণ্ড তাপ বের হয়। আর এই তাপমাত্রাতেই প্রক্রিয়া চালানো সম্ভব হয়। এই ফিউশন রিঅ্যাকশন থেকে কম শক্তি ব্যবহার করে বেশি শক্তি পাওয়া যায়। পরে এই তাপশক্তি বিদ্যুতে রূপান্তরিত করে কার্বন নিঃসারণের বিপদমুক্ত বিদ্যুৎশক্তি পাওয়া যাবে।
বর্তমানে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো ‘নিউক্লিয়ান ফিউশন’ এর ওপর নির্ভরশীল। এতে চেইন রিঅ্যাকশনের মাধ্যমে ইউরেনিয়াম অ্যাটম ভেঙে শক্তি বের হয়। এর সুবিধা হলো পারমাণবিক বর্জ্যের সমস্যা নেই এবং আকস্মিক দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও কম।
গবেষকরা গোটা বিশ্বে বিকল্প পরমাণু প্রযুক্তির সন্ধান করছেন৷ চীন সম্প্রতি ইউরেনিয়ামের বদলে থোরিয়াম চালিত চুল্লি পরীক্ষার কাজ শুরু করেছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিল গেটস ‘ন্যাট্রিয়াম’ চুল্লি গড়ে তোলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন৷ পানির বদলে তরল সোডিয়াম দিয়ে সেটির কেন্দ্রস্থল শীতল রাখা যাবে৷
প্রতিবাদ ও সমালোচনা সত্ত্বেও পরমাণু শক্তির প্রয়োগ বেড়েই চলেছে৷ মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে এ ছাড়া যেন অন্য কোনো উপায় নেই৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৪
আপনার মতামত জানানঃ