পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে ধর্ম অবমাননার দায়ে একজন শিক্ষককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে দেশটির আদালত। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ঐ শিক্ষকের নাম নতুন লাল। তিনি সিন্ধুর একটি সরকারি ডিগ্রি কলেজের একজন শিক্ষক। ধর্মে সনাতন। ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হবার পর থেকে কারাগারেই আছেন তিনি।
পাকিস্তানের গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, কারাদণ্ডের পাশাপাশি ওই শিক্ষককে ৫০,০০০ রুপি জরিমানাও করেছে আদালত।
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে ভারতের সংবাদ মাধ্যম এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছেন সাজাপ্রাপ্ত নতুন লাল দেশটির দক্ষিণপূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ সিন্ধুর বাসিন্দা। সেখানে একটি ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা করতেন তিনি।
২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওই কলেজের এক ছাত্র এক ভিডিওতে নতুন লালের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মকে অবমনানার অভিযোগ করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ভিডিও ভাইরাল হয় এবং তার পরই গ্রেপ্তার হন তিনি।
ওই শিক্ষার্থী দাবি করেন, ফিজিক্সের ওই শিক্ষক ওই দিন স্কুলে আসেন এবং নবীকে অবমাননা করেন। এর পর, জামাত-ই-আহলে সুন্নাত পার্টির একজন নেতা এবং স্থানীয় আলেম মুফতি আবদুল করিম সাইদী ব্লাসফেমি আইনে নতুন লালের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন।
এরপরই পাকিস্তানের এক আদালত গত মঙ্গলবার ওই শিক্ষককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনের জন্য দুই বার আবেদন করেছিলেন নতুন, কিন্তু দু’বারই তার আবেদন খারিজ করে দেন আদালত।
ইসলাম ধর্মের মহানবীকে অপমান করলে পাকিস্তানে বাধ্যতামূলকভাবে মুত্যুর সাজা হয়৷ প্রায় ৯৫ শতাংশ মুসলমানের এই দেশে কঠোর ব্লাসফেমি আইন কার্যকর রয়েছে৷ পাকিস্তানে ব্লাসফেমির জন্য যতটা না ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে তারচেয়ে অনেক বেশি এই আইনের বলে সংঘবদ্ধ জনতাকে হত্যা করা হয়েছে৷
ফিজিক্সের ওই শিক্ষক ওই দিন স্কুলে আসেন এবং নবীকে অবমাননা করেন। এর পর, জামাত-ই-আহলে সুন্নাত পার্টির একজন নেতা এবং স্থানীয় আলেম মুফতি আবদুল করিম সাইদী ব্লাসফেমি আইনে নতুন লালের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন।
পাকিস্তানে এই আইনের সূচনা হয় সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউল হকের অধীনে ১৯৮০ এর দশকে৷ এই আইন অনুযায়ী ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) কে অবমাননা করলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷ এছাড়া ইসলাম ধর্ম, পবিত্র কোরআনসহ নির্দিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিদের নিন্দা বা অবমাননায় কারাদণ্ডসহ কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে৷
এর আগে গত মাসে দেশটিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে ইসলামের মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) ও তার স্ত্রীকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ ব্যঙ্গচিত্র শেয়ার করা ও নবীকে নিয়ে কটূক্তি করায় এক নারীকে মৃত্যুদণ্ড দেন পাকিস্তানের আদালত।
সে সময় ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়, আনিকা আতিক (২৬) নামে ওই নারীর বিরুদ্ধে ২০২০ সালের মার্চ মাসে রাওয়ালপিন্ডির একটি আদালতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ১৯ জানুয়ারি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
দেশটির সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানে ১৯৪৭ থেকে ধর্ম অবমাননার ঘটনায় এক হাজার ৪১৫টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে এবং ওই সময় থেকে ২০২১ পর্যন্ত ধর্ম অবমাননার ঘটনায় ১৮ জন নারী এবং ৭১ জন পুরুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন।
তবে, এ ধরনের সব ঘটনায় মামলা না হওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা বেশি বলে ধারণা করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্ম অবমাননার ৭০ শতাংশেরও বেশি অভিযোগ আসে পাঞ্জাব থেকে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ধর্মবিরোধী এই ব্লাসফেমি আইনটি সাধারণত ধর্মীয় কট্টরপন্থিদের পাশাপাশি সাধারণ বহু পাকিস্তানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়৷
তারা বলছে, সংখ্যালঘুদের দমনে এই আইনের অপব্যবহার করা হচ্ছে৷ অনেক ক্ষেত্রে এমনকি মুসলিমরাও ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে একজন আরেকজনকে ব্লাসফেমি মামলায় ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন৷
আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ব্লাসফেমির অভিযোগ খুবই উদ্বেগজনক৷ কেননা, অভিযুক্ত ব্যক্তি সহিংসতার ঝুঁকিতে পড়ছেন৷ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে ব্লাসফেমি আইনের প্রয়োগ বাড়ছে উল্লেখ করে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার উস্কানিমূলক ঘটনা বন্ধে দেশটির নেতৃত্বের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তারা৷
তারা বলেন, পাকিস্তানের ইসলাম ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মীয় সংবেদনশীলতা রক্ষার লক্ষ্যে অস্পষ্টভাবে প্রণীত ব্লাসফেমি আইনগুলোর পুলিশ এবং বিচার বিভাগ নির্বিচারে প্রয়োগ করছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অনেক দেশেই ‘ব্লাসফেমি’, ‘ধর্মীয় অবমাননা’ এবং ‘ধর্মত্যাগ’ শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ বাস্তবে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক শত্রুতা, জমি নিয়ে বিরোধের ক্ষেত্রেও হাতিয়ার করা হয় এসব আইনকে৷
আরও বলেন, পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা প্রতিনিয়ত অবরোধের মধ্যে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। সংবিধান অনুযায়ী সব নাগরিকের সমান অধিকার থাকলেও তা কেবল কাগজে কলমে। হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, আহমদি এমনকি শিয়ারাও দেশটিতে অ-নাগরিক হিসাবে বিবেচিত হয়। তাদের কথা বলার অধিকার নেই। আইনের সুরক্ষার অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত।
পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। দেশটির সরকারি হিসেবে পাকিস্তানে বর্তমানে ৭৫ লাখ হিন্দু আছেন, তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের হিসেব অনুযায়ী, পাকিস্তানে বসবাসরত হিন্দুর সংখ্যা ৯০ লাখ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, পাকিস্তান এখন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য ধীরে ধীরে নরক হয়ে উঠছে। প্রতিদিনই সেখানে সংখ্যালঘুদের ওপর চলে অকথ্য অত্যাচার। অধিকাংশ সময়ই তা প্রকাশ্যে না এলেও মাঝেমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায় পাকিস্তানে উগ্র মৌলবাদীরা হিন্দুদের ওপর কী পরিমাণে অত্যাচার চালাচ্ছে।
পাকিস্তানের সরকার বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই করেনি। পাকিস্তানের জনসংখ্যার মাত্র ১.৬ শতাংশ হিন্দু। আর প্রায় রোজ তাদের অকথ্য অত্যাচারের শিকার হতে হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০৮
আপনার মতামত জানানঃ