খাগড়াছড়ির রামগড়ে অবাধে চলছে পাহাড় কাটার মহোৎসব। পাহাড় ছাড়াও কাটা হচ্ছে বনাঞ্চল ও ফসলি মাঠের জমি। প্রতি বছরই পাহাড় কাটা শুরু হয় অবৈধ ইটভাটায় মাটি দেয়ার জন্য। আইন অমান্য করে এস্কেভেটর (ভ্যাকু), কোদাল ও শাবল দিয়ে ফসলি জমির টপসয়েল ও লাল মাটির পাহাড় কাটা হচ্ছে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড় কাটা ও বালু উত্তোলনের অপরাধে জরিমানা করলেও কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সেখানে পুরোদমে আবারো পাহাড় কাটা শুরু হয়। তবে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের অজুহাত দেখিয়ে এ বছর পুরো সময় জুড়েই পাহাড় কেটে চলছে একটি চক্র। অভিযোগ রয়েছে কমিশনের বিনিময়ে এ চক্রটিকে প্রত্যক্ষ সমর্থন দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা।
স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, অভিযান চালিয়ে পাহাড় কাটা ও বালু উত্তোলনের অপরাধে লাখ লাখ জরিমানা করা হয়। অভিযান শেষে আবারও পাহাড় কাটায় ব্যস্ত হয়ে যায় পাহাড় খেকোরা।
এদিকে, দিনের পর দিন পাহাড় কাটায় জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পাশাপাশি পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন পরিবেশবাদীরা। অন্যদিকে পাহাড় কাটা বন্ধ না হওয়ায় প্রশাসনকে দোষারোপ করছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় সূত্র জানায়, রামগড়ে অন্তত ২০টি পয়েন্টে ভেকু মেশিন দিয়ে পাহাড় কেটে মাটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার সহযোগিতায় পাহাড়-টিলা ধ্বংস করা হচ্ছে। রাস্তা তৈরি কিংবা মেরামতের অজুহাতসহ নানা কৌশলে কাটা হচ্ছে পাহাড় ও টিলা।
রামগড়ে কোদাল দিয়ে মাটি কেটে ও তা বহনের জন্য ওয়া (মাথায় করে মাটি বহনের টুকরি) ব্যবহারের শর্তে সোনাইআগা এবং তৈছালা ছড়া এই দু’টি জায়গায় মাটি ও বালু উত্তোলনের ইজারা দেয়া হয়। অথচ রামগড়ের বিভিন্ন জায়গায় অন্তত ৩০টি পয়েন্টে এস্কেভেটর ব্যবহার করে নির্বিচারে পাহাড় কেটে মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে। স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার ছত্রছায়ায় পাহাড়-টিলা ধ্বংস করা হচ্ছে। রাস্তা তৈরি বা মেরামতের অজুহাতসহ নানা কায়দা-কৌশলে কাটা হচ্ছে পাহাড়-টিলা। যার বিনিময়ে পাহাড়খেকো চক্র থেকে নিয়মিত কমিশন নেয় কয়েকজন নেতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাটি ব্যবসায়ী জানান, এক ড্রামট্রাক পাহাড় কাটা মাটি বিক্রি করা হয় ১২০০ টাকা থেকে ১৪০০ টাকায়। আর ফসলি জমির মাটি বিক্রি হয় ১৮৫০ টাকা। ইটের ভাটায় সরবরাহ করা এক ড্রামট্রাক মাটি বিক্রির ১৮৫০ টাকার মধ্যে পায় ১৪০০ টাকা পায় তারা আর ৪৫০ টাকা যায় সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণকারীদের কাছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রামগড়ের পাতাছড়া, বলিপাড়া, চিনছড়ি পাড়া, বৈদ্যটিলা, তৈচালা, নুরপুর, ঢাকাইয়া কলোনি, কালাডেবা, সোনাইআগা, খাগড়াবিল, শ্মশানটিলা, নজিরটিলা, ভতপাড়া, বল্টুরাম টিলা, জগন্নাথ পাড়া, নাভাংগা, লালছড়ি, নোয়াপাড়া ও চাষিবাড়ির অন্তত ২০টি স্থানে পাহাড় কাটা হচ্ছে। আইন অমান্য করে ভেকু মেশিন, কোদাল ও শাবল দিয়ে পাহাড় কাটা হয়। পাহাড়ের ওপরের অংশ ন্যাড়া করে উজাড় করা হয়েছে গাছপালা। কোথাও খাড়াভাবে, আবার কোথাও কাটা হচ্ছে আড়াআড়িভাবে। কিছু কাটা হচ্ছে চূড়া থেকে। এসব মাটি ইটভাটা, পুকুর ভরাট, রাস্তা সংস্কারসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে ব্যবহৃত হয়।
অভিযোগ রয়েছে, মাটি ব্যবসায়ীরা একশ্রেণীর দালাল দিয়ে সাধারণ কৃষককে লোভে ফেলে পাহাড় ও ফসলি জমির মাটি বিক্রিতে উৎসাহিত করছে। যার ফলে নিজের ভিটের মাটি পর্যন্ত বিক্রি করতে দ্বিধা করে না তারা।
নজির টিলা এলাকায় পাহাড়ের উপর পরিবার নিয়ে থাকেন জসিম উদ্দীন নামের এক ব্যক্তি। দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে নিজের ভিটের মাটি বিক্রি করতেন তিনি। খবর পেয়ে পাহাড় কাটার অপরাধে তাকে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করে রামগড় উপজেলা প্রশাসন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্কুলশিক্ষক জানান, রামগড়-ফেনী মহাসড়কসহ উপজেলার প্রতিটি অলিগলির রাস্তাগুলো যেন একরকম মারণফাঁদে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন ইটভাটার ব্যবহারের জন্য ডাম্পার, মিনি ট্রাক দ্বারা সরবরাহ করা কাঠ ও মাটি পড়ে নষ্ট হচ্ছে সড়কটি। চরম জনদুর্ভোগের সম্মুখীন হচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রশাসনেরর কোনো কার্যকর নজরদারি নেই। যার জন্য অবাধে এসব পাহাড় কেটে পার পেয়ে যাচ্ছে তারা।
দিনের পর দিন পাহাড় কাটায় জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পাশাপাশি পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন পরিবেশবাদীরা। অন্যদিকে পাহাড় কাটা বন্ধ না হওয়ায় প্রশাসনকে দোষারোপ করছেন স্থানীয়রা।
রামগড় উপজেলার বাসিন্দা আশিকুর রহমান সুমন বলেন, এভাবে পাহাড় কাটতে থাকলে রামগড়ে একটি পাহাড়ও থাকবে না। ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে মানুষ। প্রতি বছর এমনিতে পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। প্রশাসনের এখনই সঠিক সময় এ পাহাড়খেকো চক্রকে থামানো।
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পাহাড় কাটার বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান কাজী নুরুল আলম বলেন, কারো ব্যক্তিগত দায় আওয়ামী লীগ নেবে না। যারা এ বেআইনি কাজে নিয়োজিত আছে তারা নিজ দায়িত্বে এসব করছে। দল কাউকে এসবে সমর্থন বা সহযোগিতা দেয় না এবং দেবে না।
রামগড় পৌরসভার মেয়র রফিকুল আলম কামাল বলেন, পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
বাংলাদশে পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মুফিদুল আলম বলেন, পাহাড় কাটা গুরুতর অপরাধ। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে জেলা প্রশাসক এবং ইউএনওকে জানানো হবে।
রামগড়ের ভারপ্রাপ্ত ইউএনও উম্মে হাবিবা মজুমদার বলেন, যখনই পাহাড় কাটার খবর পাই তখনই অভিযানে যাই। ইতোমধ্যে দুই ব্যক্তিকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় খালখন্দ, বাড়িঘর নির্মাণে ভরাটের কাজে আর ফসলি জমির মাটির বেশির ভাগ ব্যবহৃত হচ্ছে উপজেলার রামগড় পৌরসভা ও ইউনিয়নে ৮/৯টি ইট ভাটা। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ফসলি জমির টপসয়েল কেটে ট্রাক দিয়ে এসব ভাটায় ইট প্রস্তুতের জন্য মাটি জমা করা হচ্ছে। মাটি ব্যবসায়ীরা এক শ্রেণীর দালাল দিয়ে সাধারণ কৃষককে লোভে ফেলে ফসলি জমির মাটি বিক্রিতে উৎসাহিত করছেন। আর কৃষকরা লোভে পড়ে নগদ টাকার আশায় ফসলি জমির মাটি বিক্রি করে দেন। ৮-১০ ফুট গভীর করে মাটি কাটার ফলে অনেক জমিই ডোবায় পরিণত হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে জোর করে ফসলি জমি কিংবা টিলার মাটিও কেটে নিচ্ছে বিক্রিতে বাধ্য করা হচ্ছে।
প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আরও কয়েকটি সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটগুলোর নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাধীন দলের কয়েকজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি। মূলত এ জনপ্রতিনিধিরাই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তথা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবৈধ মাটির ব্যবসার সুযোগ করে দেন। আর এর বিনিময়ে তাদের পকেটে ঢুকছে লাখ-লাখ টাকা।
স্থানীয়দের অভিমত, প্রতি বছর শত একর ফসলি জমির মাটি কাটা হচ্ছে। যার কারণে দিন দিন আবাদী জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদন ও জীববৈচিত্র মারাত্মক হুমকিতে পড়ছে। তাদের অভিমত বেপরোয়া মাটি খেকোদের না রুখলে রামগড়ের আশপাশের পাহাড়গুলো অচিরেই বিলীন হয়ে যাবে। এতে পরিবেশ বিপর্যয়সহ রয়েছে প্রাণহানীর আশংকা।
অপরদিকে, পাহাড়ের লালমাটি ব্যবহার করা হচ্ছে বাড়ি নির্মাণ, ডোবা ভরাট, রাস্তা সংস্কার, রাস্তা নির্মাণ, বিভিন্ন বেসরকারি ও মালিকানাধীন স্থাপনা নির্মাণ এবং ইট ভাটাসহ বিভিন্ন কাজে। অনেকে আবার অনুমতি ছাড়াই পুকুর কাটার কথা বলে মাটি বিক্রি করে দিচ্ছেন। শুধু দিনের আলোয় নয়, রাতের আধাঁরেও চলে লাল মাটির পাহাড় কাটা। প্রশাসনের নজরদারি এড়াতে মাটি ব্যবসায়ীরা রাতের সময়কে উত্তম হিসাবে বেছে নেন।
বিগত কয়েক বছরে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড়-মাঝারি আকারের শতাধিক পাহাড় টিলা কেটে সাবাড় করা হয়েছে। বৈদ্যটিলা, সম্প্রপাড়া, খাগড়াবিল প্রভৃতি এলাকায় পাহাড় কাটতে গিয়ে মাটি চাপায় কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। বর্তমানে চিনছড়িপাড়া, শ্মশানটিলা, নজিরটিলা, বাগানটিলা, বলিটিলা, বৈদ্যটিলা, কালাডেলা, সোনাইআগা, বলিপাড়া, বথপাড়া, খাগড়াবিল, লালছড়ি, নোয়াপাড়া, নাকাপা ও পাতাছড়ার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কাটা হচ্ছে। নির্বিচারে পাহাড়, টিলা কাটার কারণে বনাঞ্চলও ধ্বংস হচ্ছে। এতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকীর মুখে পড়ছে। এছাড়া বর্ষায় পাহাড়গুলোতে ব্যাপক ধসের আশংকা রয়েছে।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, পাহাড় ও বন কাটার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বা পরিবেশ আদালতে মামলা করেই যেন পরিবেশ অধিদপ্তর দায়িত্ব শেষ। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং পাহাড় ধ্বংসকারীদের আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। জরিমানা ছাড়াও পাহাড় বেষ্টনী দিয়ে বনায়ন করতে হবে।
তারা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, সেগুলোতে একই অপরাধ বারবার হলে শাস্তির মাত্রা কয়েক গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পরিবেশ আইনে যদি এমন দুর্বলতা থাকে, তাহলে তা দূর করা এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ দ্রুতই পাহাড়শূন্য হয়ে যাবে, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল বলে কিছু থাকবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ