ইতিমধ্যেই কেন্দ্র দখল, ব্যালটে সিলমারা, ককটেল বিস্ফোরণ, দফায় দফায় সংঘর্ষ, টেঁটাযুদ্ধ, গুলি ও মারামারির মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সচেতন নাগরিক সমাজ। তবে সব সমালোচনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার আর স্বেচ্ছাচারিতার নতুন নজির গড়তেই মন আর মনোযোগ আ’লীগ নেতাদের।
সম্প্রতি কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার ১৩ নম্বর জোয়াগ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীর ছেলে মিজানুর রহমান খানের বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।
ওই ইউনিয়নের পাঁচপুকুরিয়া গ্রামের এক উঠান বৈঠকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বক্তব্য দেন মিজানুর রহমান। পরে রাত ১০টার পর তার এ বক্তব্য ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
সেখানে তিনি বলেন, এটা আমার নির্দেশ ‘মার খেয়ে আসা যাবে না, মার দিয়ে আসতে হবে, তার জন্য যদি ১০টা মার্ডারও করা লাগে তাই করে আসবেন। আমি বাকিটা দেখব ইনশাআল্লাহ।
ওই ভিডিওতে মিজানুরকে আরও বলতে শোনা যায়, ‘ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছি, যদি আমার লোকদের এক ফোঁটা রক্ত ঝড়ে, আপনি দশ ফোঁটা রক্ত নিয়ে আসবেন, বাকিটা আমি দেখব, ইনশাল্লাহ। ছাড় দেয়া যাবে না, এক চুল পরিমাণও ছাড় দেব না।
‘মিজান কী জিনিস এখনও জোয়াগের অনেক লোক জানে না। যখন নমিনেশন নিয়ে আসছি তখন থেকেই জানা উচিত।’
বক্তব্যের সময় তার পিতা আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আব্দুল আউয়ালও উপস্থিত ছিলেন।
আব্দুল আউয়াল বলেন, আমাকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য একটি পক্ষ ভিডিওটি ছড়িয়েছে।
আপনার ছেলে মার্ডার করার নির্দেশ কেন দিল— এমন প্রশ্নের জবাবে উত্তর না দিয়ে তিনি এড়িয়ে যান।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার প্রতিপক্ষ নিয়মিত হুমকি দিয়ে আসছে। আমার জন্য দোয়া করবেন।
‘মিজান কী জিনিস এখনও জোয়াগের অনেক লোক জানে না। যখন নমিনেশন নিয়ে আসছি তখন থেকেই জানা উচিত।’
চান্দিনা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ বলেন, এই ভিডিওটি আমি গতকাল রাতে দেখেছি। ঘটনাটি দুঃখজনক। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না।
কুমিল্লার আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. দুলাল তালুকদার বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চান্দিনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিফুর রহমান বলেন, আমি ভিডিওটি দেখেছি। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা করবো।
এদিকে আজ শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর) দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর রুনি মিলনায়তনে গত এক বছরের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, চলতি বছর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের সহিংসতায় সারা দেশে নিহত হয়েছেন ১১৩ জন। এছাড়া পৌর ও সিটি করপোরেশন ভোটের সংঘাতে প্রাণহানি ঘটেছে আরও ১৩ জনের।
আসক জানায়, ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৬৭২টি ঘটনায় ১১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় ৭ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।
পৌর ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৮৩টি সহিংসতার ঘটনায় ১৩ জন নিহত হয়েছে এবং ২০২১ সাল জুড়ে সারাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতে ১৫৭ জন মারা গেছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, এবারের ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে সরকারদলীয় প্রার্থী ও নেতাকর্মীরা কেন্দ্র দখল, ভোট চুরি করার কৌশল, নৌকায় ভোট না দিলে এলাকা ছাড়ার হুমকি প্রকাশ্যেই দিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের সার্বিক এক পরিস্থিতি উঠে আসে। দেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র যে সঠিক প্রক্রিয়ায় আগাচ্ছে না তারই নমুনা হিসাবে এসব তুলে ধরতে চান বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, অনেক স্থানেই সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মারা, আগের রাতেই ভোট দিয়ে ফেলার অভিযোগসহ ভোট না দিলে রাতে ঘুমাতে না দেওয়ার হুমকি, ভোট না দিতে ঘর থেকে বের না হওয়ার হুমকিসহ আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে। সরকারদলীয় নেতাদের এমন ভোট চুরি করার কৌশল আর ভোট না দিলে হুমকি দেওয়ার ফলে দেশে নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী অন্য দলগুলো ইউপি নির্বাচনে সরাসরি অংশ না নিলেও তাদের তৎপরতা থেমে নেই। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন। আবার আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরাও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এ কারণে নির্বাচন ঘিরে সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনা বেড়ে চলেছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বলছেন, ইউপি নির্বাচনকেন্দ্রিক বেশিরভাগ সহিংসতা হচ্ছে আওয়ামী ঘরানার প্রার্থীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে। স্থানীয় পর্যায়ে সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও প্রভাবশালী নেতারা নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচনে জয়ী করতেই জন্ম দিচ্ছে সহিংসতার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০৪
আপনার মতামত জানানঃ