যুক্তরাষ্ট্রের কোভিড ত্রাণ তহবিল থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার চুরি হয়েছে। করোনা মহামারির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি হারানো নাগরিক ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার জন্য দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার এই ত্রাণ তহবিল গঠন করেছিল। এ পর্যন্ত তহবিল থেকে ৩ শতাংশ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক বিভাগ চাকরি হারানো বেকার নাগরিকদের আর্থিক সহায়তা প্রদানে অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ তোলে। এরপর মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৫১টি অঙ্গরাজ্যের প্রত্যেকটিতেই তহবিলের অর্থ চুরির ঘটনা ঘটেছে। ইতোমধ্যে নয়’শটি চুরির ঘটনা উদঘাটন ও তদন্ত করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এছাড়া এই ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এক’শ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংখ্যাটা আরও বাড়বে বলেও উল্লেখ করেছেন কর্মকর্তারা।
ফেডারেল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলেছে, তারা বেকারত্ব বীমা এবং ঋণ জালিয়াতির তদন্ত করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ১.২ বিলিয়ন ডলারের বেশি জব্দ করেছে এবং লেনদেনগুলোর প্রক্রিয়া পাল্টে দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে লুট হওয়া তহবিলের ২.৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি ফেরত নিতে সক্ষম হয়েছে। এই তদন্তের ফলে ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার দেশে মহামারীর সময় হওয়া জালিয়াতি তদন্তে সহকারী বিশেষ এজেন্ট রয় ডটসনকে সমন্বয়কারী হিসেবে নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে ফেডারেল এজেন্সি। কোভিড -১৯ ত্রাণ অ্যাপ্লিকেশনগুলির জালিয়াতিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য সিক্রেট সার্ভিসের চলমান তদন্তে সমন্বয় করবেন।
রয় ডটসন জানিয়েছেন, ‘সিক্রেট সার্ভিসের বর্তমানে মহামারি সংক্রান্ত ত্রাণ তহবিল জালিয়াতির বিষয়ে ৯০০টিরও বেশি অপরাধ তদন্ত রয়েছে। এটি মহামারির সময় দেওয়া বিভিন্ন সুবিধা এবং অন্যান্য সমস্ত সুবিধার সুযোগ নিয়ে করা জালিয়াতিও তদন্ত করা হবে। সিক্রেট সার্ভিস মাঠে নেমেছে, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চুরি হওয়া তহবিলসহ আমরা যা কিছু করতে পারি তা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছে।’
জালিয়াতি হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধার বিষয়ক গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ক রয় ডটসন এক সাক্ষাৎকারে জানান, তাদের কাছে আসা মামলা, শ্রম দফতর এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রশাসনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চুরি হওয়া অর্থের হিসেব করা হয়েছে। বিচার বিভাগ যেসব মামলার বিচার করছে সেগুলো এই হিসেবে আসেনি।
ডটসন বলেন, বিতরণ করা তিন লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলারের মাত্র তিন শতাংশ চুরি হয়েছে। তবে মহামারি সহায়তা কর্মসূচি থেকে অর্থ চুরির মাধ্যমে অপরাধীদের তৎপরতা বোঝা গেছে।
বেশিরভাগ অর্থ জালিয়াতি হয়েছে বেকারত্ব খাত থেকে। শ্রম বিভাগ জানিয়েছে প্রায় আট হাজার সাতশ’ কোটি ডলার যথাযথভাবে বিতরণ করা হয়নি। এর মধ্যে বড় অংশই জালিয়াতি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ৫১টি অঙ্গরাজ্যের প্রত্যেকটিতেই তহবিলের অর্থ চুরির ঘটনা ঘটেছে। ইতোমধ্যে নয়’শটি চুরির ঘটনা উদঘাটন ও তদন্ত করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এছাড়া এই ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এক’শ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
শ্রমবিভাগ জানিয়েছে, চাকরিহারাদের সাহায্যের জন্য যে টাকা রাখা হয়েছিল, অনেকাংশে তা দেয়াই হয়নি। মোট ৮ হাজার ৭০০ কোটি ডলার অর্থ অবৈধভাবে লেনদেন হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা তদন্তে নেমে ১০০ কোটি ২০০ ডলার বাজেয়াপ্ত করেছে। এই অর্থই কাজ-হারাদের বিমা এবং ঋণের প্রকল্প থেকে তছরুপ করা হয়। এছাড়া আরো ২০০ কোটি ৩০০ ডলার ত্রাণ প্রকল্পের সহযোগী সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, বেকারত্ব ইন্সুরেন্স এবং ঋণ জালিয়াতির ঘটনা তদন্তের সময় তারা এক হাজার দুইশ’ কোটি ডলারের বেশি জব্দ করেছে। এসব ঘটনায় প্রায় নয়শ’ অপরাধী তদন্তের আওতায় রয়েছে। আর এখন পর্যন্ত একশ’রও বেশি জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, মহামারির শুরুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী সংক্রান্ত জালিয়াতির ওপর বেশি জোর দেয়। কর্তৃপক্ষ এখন মহামারি সংশ্লিষ্ট ত্রাণ তহবিল সংক্রান্ত জালিয়াতির ওপর বেশি জোর দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আঘাত হানে করোনা। এরপর গত দুই বছর ধরে দেশটির জনজীবনে রীতিমতো তাণ্ডব চালায় মহামারি। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে দেশটির অর্থনীতির ওপরও। লকডাউন ও কঠোর করোনা বিধিনিষেধের কারণে লাখো-কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, ছোটখাটো খুচরা ব্যবসা করে যারা জীবিকা অর্জন করতেন, মহামারির কারণে তাদেরও উপার্জন এক রকম বন্ধ হয়ে গেছে।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের আর্থিক প্রণোদনার সিদ্ধান্ত ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনে। কিন্তু তহবিল চুরির ঘটনায় জনমনে বিষাদ নেমে এসেছে। চুরির তথ্য সামনে আসায় বেশ বিব্রত অবস্থায় পড়েছে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সরকার।
তবে প্রশাসন চুরির তদন্ত কার্যক্রমকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে উল্লেখ করে গোয়েন্দা কর্মকর্তা ডটসন বলেছেন, ‘আমরা কি চুরি-জালিয়াতি চিরতরে বন্ধ করতে পারব, পারব না। আমরা বড়জোর যা করতে পারি, তা হলো এই জঘন্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের বিচারের আওতায় আনা এবং উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া। এখন আমরা এই কাজই করছি।’
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে প্রায় ৪ কোটি মানুষ। সম্প্রতি প্রকাশিত মার্কিন সেন্সাস ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০২০ সালে দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৭০ লাখ। এটা মোট জনগণের প্রায় ১১.৪ শতাংশ। করোনা মহামারির কারণে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। প্রায় অর্ধেক মার্কিন পরিবারই সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।
করোনা মহামারির কালো থাবায় মন্দায় পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। থাবা থেকে বাদ যায়নি বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিও। বাইডেন প্রশাসনের নানা ধরনের সহযোগিতার পরও খাদ্য সংকটে পড়েছে দেশটির দুই কোটিরও বেশি মানুষ।
উত্তর আমেরিকার এই দেশটির আদমশুমারি ব্যুরো থেকেই এই পরিসংখ্যান সামনে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বড়দিন এবং নববর্ষসহ ছুটি ও উৎসবের মৌসুমে খাবার সংকটে ভোগা আমেরিকানদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারি ব্যুরোর অনুমান, ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকে খাবার সংকটে ভুগছেন ২ কোটি ১০ লাখেরও বেশি মার্কিন নাগরিক। মূলত করোনা মহামারিকালীন মার্কিন সরকারের দেওয়া অর্থ সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
আলজাজিরা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো শিগগিরই আরও আর্থিক চাপে পড়তে যাচ্ছে। কারণ দেশটিতে শিশু ট্যাক্স ক্রেডিট পেমেন্ট বন্ধ হতে যাচ্ছে এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সমর্থিত এই কর্মসূচির মেয়াদ আরও বাড়ানোর ব্যাপারে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে কার্যত অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারী ব্যুরো থেকে চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত সংগ্রহ করা হাউজহোল্ড পালস জরিপের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, দেশটিতে মাঝে মাঝে বা প্রায়ই খাবার সংকটে ভুগছে এমন পরিবারের সংখ্যা চলতি মাসে বৃদ্ধি পেয়ে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছে। যা গত ৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এছাড়া এক বছর আগের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। একইসঙ্গে পণ্যের চাহিদা বাড়ছে বলেও দেখতে পাচ্ছে ফুড ব্যাংকগুলো। এই পরিস্থিতিতে অপুষ্টিতে ভোগা এবং অনাহারে-অর্ধহারে থাকা শিশুদের প্রতি সহায়তাও বেড়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০২
আপনার মতামত জানানঃ