অসাম্প্রতিক ইরান হামলার মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো যে, মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের সামরিক সম্পৃক্ততা এখনো থামেনি, বরং আরও বিস্তৃত হচ্ছে। সর্বশেষ ইরানি পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা এবং তার পেছনে জড়িত বিপুল সামরিক ব্যয় ও প্রাণহানি যেন নতুন করে প্রশ্ন তোলে—এই যুদ্ধ কি শেষ হবে না কখনো? নাকি এটি একটি নিরবচ্ছিন্ন সাম্রাজ্য বিস্তারের অংশ?
যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল ড্যান কেইনের ভাষ্য অনুযায়ী, ইরানের ফর্দো ও নাতাঞ্জে সাতটি বি-টু স্টেলথ বোমারু বিমান দিয়ে ১৪টির বেশি বাংকার-বিধ্বংসী বোমা ফেলা হয়েছে। প্রতিটি বিমানের দাম যেখানে ২১০ কোটি ডলার, সেখানে এই পুরো অভিযানের খরচ দাঁড়ায় শত শত কোটি ডলারে। শুধু বোমা ছোঁড়াই নয়, এতে যুক্ত হয় আরও ১২৫টিরও বেশি যুদ্ধবিমান—বোমারু, জঙ্গি, নজরদারি, জ্বালানিবাহী ও সহায়ক উড়োজাহাজ—প্রতিটি বিমানের পিছনে খরচ হয় কোটি কোটি ডলার।
এই অর্থনৈতিক ব্যয়ের চিত্র আরও বিস্তৃত হলে বোঝা যায়, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র একাই সামরিক খাতে ব্যয় করেছে ৯৯ হাজার ৭০০ কোটি ডলার, যা গোটা বিশ্বের সামরিক ব্যয়ের ৩৭ শতাংশ। এমনকি এই পরিমাণ ব্যয় বিশ্বের পরবর্তী ৯টি দেশের মিলিত সামরিক বাজেটের চেয়েও বেশি। চীনের চেয়ে প্রায় তিন গুণ এবং রাশিয়ার তুলনায় সাত গুণ বেশি সামরিক খরচ করা দেশ যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রশ্নের মুখে—এই অতিব্যয়ের পরিণাম কী?
কেবল অর্থব্যয় নয়, এই যুদ্ধে যে পরিমাণ প্রাণহানি ঘটেছে, তাও স্তব্ধ করে দেয় বিবেক। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুসারে, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ আরও কয়েকটি অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সংঘাতে সরাসরি ৯ লাখ ৪০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। তবে পরোক্ষ মৃত্যু—যেমন অনাহার, চিকিৎসাহীনতা কিংবা যুদ্ধ-উৎপন্ন রোগে মৃত্যু—ধরে এই সংখ্যা ৪৫ থেকে ৪৭ লাখে গিয়ে পৌঁছেছে।
এ সংখ্যার মাঝে আছে অন্তত ৩০ হাজার মার্কিন সেনা ও মিত্রসেনাদের প্রাণ। শুধু আফগানিস্তানেই প্রায় ২০ বছর ধরে চলা মার্কিন সামরিক অভিযানে ২ লাখ ৪৩ হাজার মানুষের প্রাণ গেছে। ইরাক যুদ্ধসহ একত্রে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৫৮ হাজারে।
এই দীর্ঘযুদ্ধের অর্থনৈতিক মূল্যও ভয়াবহ। ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের হিসাব মতে, যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তানে যুদ্ধে ব্যয় করেছে আনুমানিক ৫ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরাসরি খরচ ২ লাখ ১০ হাজার কোটি ডলার, হোমল্যান্ড সিকিউরিটির ব্যয় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি ডলার, এবং যুদ্ধকালীন ঋণের সুদের জন্য ব্যয় করা হয়েছে আরও ১ লাখ কোটি ডলার।
এই ব্যয়ের গণ্ডি এখানেই থামে না। আগামী ৩০ বছরে যুদ্ধফেরত সেনাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আরও অন্তত ২ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে, যা নিয়ে যুদ্ধ-পরবর্তী সম্ভাব্য মোট ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৮ লাখ কোটি ডলার। এই বিশাল খরচ দেশটির নাগরিকদের কাঁধে বর্তাবে করের বোঝা হয়ে, অথচ যুদ্ধের ফলাফল এখনো অস্পষ্ট।
এদিকে, একই সময়ে ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার ছবিটিও প্রশ্ন তোলে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার আদর্শ নিয়ে। ১৯৫৯ সাল থেকে মুদ্রাস্ফীতি অনুযায়ী হিসেব করলে, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পেয়েছে অন্তত ২৫ হাজার ১২০ কোটি ডলারের সহায়তা। ২০১৬ সালে স্বাক্ষরিত ১০ বছরব্যাপী একটি চুক্তির আওতায় দেশটি প্রতিবছর পায় ৩৮০ কোটি ডলার। কিন্তু গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মাত্র এক বছরেই ইসরায়েলকে দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত ১ হাজার ৭৯০ কোটি ডলার, যা রেকর্ড পরিমাণ।
তবে এসব সাহায্য শুধু আর্থিক সহযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এই অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে, যার ফলে জাতিসংঘসহ বিশ্বের নানা সংস্থা ও বিশ্লেষকেরা এটিকে ‘গণহত্যার অর্থায়ন’ বলেও চিহ্নিত করছেন।
প্রশ্ন হলো—এই বিপুল খরচ, প্রাণহানি ও রাজনৈতিক জটিলতার পরও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কি নিরাপদ? নাকি এসব কর্মকাণ্ডই সেখানে ঘৃণা, সন্ত্রাসবাদ ও অস্থিতিশীলতার বীজ বপন করছে?
যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক নীতির পেছনে যে কৌশলগত লক্ষ্য রয়েছে, তা হয়তো দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব জানে, কিন্তু সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করছে—এই যুদ্ধ কি কেবল তেল, অস্ত্র এবং ভূরাজনীতির খেলা? নাকি আদতে এটি এক ধরনের আধুনিক উপনিবেশবাদ, যেখানে গণতন্ত্রের নামে ধ্বংস ও দখল প্রতিষ্ঠা করা হয়?
বিশ্ব আজ এক অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে প্রতিটি বোমা শুধু কোনো ঘর নয়, ধ্বংস করে দেয় মানবতা ও মানব সভ্যতার আশা। প্রশ্ন এখন—এই যুদ্ধ কবে থামবে? থামবে কি আদৌ? নাকি আমরা দাঁড়িয়ে আছি আরও ভয়াবহ এক যুদ্ধযুগের দোরগোড়ায়?
আপনার মতামত জানানঃ