বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের মুহূর্ত এখন। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ, নিবন্ধন স্থগিত, নেতৃত্বের বড় অংশ বিদেশে কিংবা কারাবন্দি। অথচ এ দলের লাখ লাখ সমর্থক এখনো দেশে আছেন—নিশ্চুপ, কিন্তু নির্ধারক। সেই নিরব ভোটাররা কাকে ভোট দেবেন, তা নিয়েই রাজনৈতিক মহলে উত্তেজনা তুঙ্গে।
লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ‘ওয়ান টু ওয়ান’ বৈঠকের পর নির্বাচন কমিশনের আচরণ ও প্রস্তুতিতে স্পষ্ট হয়েছে, নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব নির্বাচনী উপকরণ প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়েছে এবং ডিসেম্বরেই তফসিল ঘোষণার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু মূল প্রশ্নটা ভোটারদের ঘিরেই—বিশেষ করে আওয়ামী ঘরানার ভোটারদের নিয়ে।
বিএনপির মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই তাদের ভোটাররা এবার তাদের দিকেই ঝুঁকবে। কিন্তু বাস্তবতা কি এতটা সহজ? আওয়ামী সমর্থকেরা ধর্মভিত্তিক দলের প্রতি অনাস্থাশীল, আবার বামপন্থীদের জয়লাভের সম্ভাবনা না থাকলে সেদিকেও আগ্রহ কম। ফলে বিএনপিই একমাত্র লাভবান হবে এমনটা নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না।
বড় সমস্যা হলো রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাব। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ বেশ কয়েক দফা বৈঠক করেও মৌলিক বিষয়ে একমত হতে পারেনি। সংবিধানের মৌল নীতি, রাষ্ট্রপতি-পদমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, ৭০ অনুচ্ছেদের পরিবর্তন, জাতীয় সাংবিধানিক কমিটি—এসব নিয়ে নানা মতভেদ রয়ে গেছে। বিএনপি কিছু সংস্কার মানতে রাজি হলেও শর্ত সাপেক্ষে। ইসলামি দলগুলো আবার একদল বহুত্ববাদের বিরুদ্ধে, আরেকদল চায় সংবিধানের আগের রূপ ফিরিয়ে আনতে।
এদিকে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন এই নির্বাচনে বড় চমক। আগে যাদের নিবন্ধন বাতিল হয়েছিল, এখন তারাই ২৯৬টি আসনে প্রার্থী দিয়ে এগিয়ে। তুলনায় বিএনপি অনেক আসনে একাধিক প্রার্থী নিয়ে দ্বিধায়। অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপির মতো দলগুলো নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট না করলেও, জামায়াত স্বতন্ত্রভাবে ও সুসংগঠিতভাবে মাঠে নামছে।
তবে বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে—আওয়ামী সমর্থকরা ভোট দেবে তো? ভোটকেন্দ্রে না গেলে নির্বাচনের অংশগ্রহণ কতটা বৈধতা পাবে? জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইসের মতে, আওয়ামী লীগ না থাকলেও যদি জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়, তবেই নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক বলে বিবেচিত হতে পারে। অর্থাৎ, অংশগ্রহণ বাড়ানোর দায় নির্বাচন কমিশনের কাঁধে।
তথ্য বলছে, ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ভোটে খুব একটা ব্যবধান ছিল না। দুই পক্ষের ভোটের পার্থক্য কখনো ১ শতাংশের নিচে, কখনো ৮-১০ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। এর মানে, ভোটারদের মুডই ঠিক করবে কে জিতবে।
বিএনপি আশাবাদী, এবার তারা আওয়ামী ভোটারদের পাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—তারা কি নিঃশর্তভাবে বিএনপির ঘরে ঢুকবে? নাকি ভোটদানে বিরত থাকবে? নাকি অন্য কোনো বিকল্পের দিকে তাকিয়ে থাকবে? আওয়ামী সমর্থকরা ভোট দিলে নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে, না দিলে বৈধতার প্রশ্ন উঠবে। আর তারা কাকে ভোট দেয়, সেটাই ঠিক করবে পরবর্তী শাসক কে হবে।
তাই বলা যায়, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে নির্বাচনের ভাগ্য এখন নির্ভর করছে সেই অনুগত কিন্তু সদ্য-বিচারহীন এক জনসমষ্টির ওপর, যাদের ভোটই হতে পারে এই নির্বাচনের গেম-চেঞ্জার।
আপনার মতামত জানানঃ