প্রায় দুই যুগের শোষণের পর ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয় পেয়েই পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয় বাংলাদেশ। এই দরিদ্র দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিংগার তখন মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা, সাইক্লোন জর্জরিত ও তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
চলতি বছর মার্চ মাসে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করল এবং দেখালো যে এটি পাকিস্তানের তুলনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৩২২ বিলিয়ন ডলার ছুঁতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের একজন নাগরিকের গড় আয় একজন পাকিস্তানির থেকে অনেক বেশি।
সূচক বিবেচনার বাইরে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি শক্তিশালী তার আত্মপ্রকাশ হবে এ বছরই। যদিও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে দুই বছর আগে, আর মাথাপিছু জিডিপিতে ছাড়িয়েছে তিন বছর আগে। আইএমএফ বলছে, ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে ২০২১ সালে পাকিস্তান যে পিছিয়ে পড়তে যাচ্ছে সে অবস্থান থেকে পাকিস্তান আর বাংলাদেশকে ধরতে পারছে না সহসাই।
অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রেই পাকিস্তানকে ক্রমেই ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রতিবছরই আসছে নতুন নতুন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার খবর। অবশ্য শুধু অর্থনীতি নয়, পাকিস্তানের চেয়ে প্রায় সবক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতি ভারতের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে বাংলাদেশ।
চলতি মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা বর্তমানে ২ হাজার ২২৭ ডলার। পাকিস্তানের মাথাপিছু জিডিপি ১ হাজার ৫৪৩ ডলার। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশের থেকে ৭০ শতাংশ বেশি ধনী রাষ্ট্র ছিল। আজ বাংলাদেশ পাকিস্তানের থেকে ৪৫ শতাংশ বেশি ধনী। মাথাপিছু জিডিপিতে ভারত এখন বাংলাদেশের থেকে পিছিয়ে আছে। ২০২০-২১ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ১ হাজার ৯৪৭ ডলার।
বাংলাদেশের অর্থনীতি পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে এবং এটা শীঘ্রই বিশ্বের ২৬ তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচক ২০১৭ সালে ছিল ০.৬০৮। পাকিস্তানের ২০১৮ সালে ছিল ০.৫৬০; যেটা কিনা দেশটকে মধ্যম মানব উন্নয়ন সূচক দেশের তালিকায় রাখে।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের বৈশ্বিক সাহায্যের উপর নির্ভরতা ছিল ৮৮ শতাংশ। ২০১০ সালে তা কমে ২ শতাংশের কিছু উপরে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দাতা দেশগুলোর উপর পাকিস্তানের নির্ভরতা দেশটিকে পঙ্গু করে তুলেছে।
বাংলাদেশের এই উন্নতি মূলত তিনটি বিষয়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। রপ্তানি, সামাজিক উন্নয়ন এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা। ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতি বছর ৮.৬ শতাংশ বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ দেশটির তৈরি পোশাক শিল্প। চলতি বছর মার্চ মাসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটির রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। গত এক দশক ধরে যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ।
শ্রম খাতে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে ভারত ও পাকিস্তানে এই অংশগ্রহণ কমেছে। বাংলাদেশে মাথাপিছু ঋণ জিডিপির ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের প্রায় ৯০ শতাংশ।
বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উৎস, দেশটির প্রবাসীরা। ২০২০-২১ অর্থনৈতিক বছরের প্রথম দশ মাসে দেশটি ২০ বিলিয়ন রেমিট্যান্স অর্জন করেছে। নতুন রেকর্ড এটি। ২০২০-২১ সালে ভারতের অর্থনীতি ৭.৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। দশকের সর্বনিম্ন। যেক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্প্রসারিত হয়েছে ৫.৮ শতাংশ।
চলতি বছর বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০ মিলয়ন ‘কারেন্সি সোয়াপ’ ঋণ নিয়ে শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলার। যেখানে শ্রীলঙ্কার মাত্র ৪.৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে আট মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫৩
আপনার মতামত জানানঃ