বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা, যা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকে একটি একক পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের একাধিক কারণ আমাদের সামনে দণ্ডায়মান। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে এটি যতটা না প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট, তার থেকেও বেশি মানবসৃষ্ট। মানবসৃষ্ট একাধিক কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে প্লাস্টিক।
প্লাস্টিক হলো সিনথেটিক বা সেমি-সিনথেটিক ও নিম্ন গলনাঙ্কবিশিষ্ট পদার্থ, যা তাপীয় অবস্থায় যেকোনো আকার ধারণ করতে পারে এবং পুনরায় কঠিনে রূপান্তরিত হতে পারে। প্লাস্টিক স্থায়ী, সহজলভ্য, সস্তা এবং সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় আমরা সবাই প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল এমনকি উন্নত দেশেও প্লাস্টিক একটি নিত্য ব্যবহার্য বস্তু। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য প্লাস্টিক চাহিদা ব্যাপক। দিনের পর দিন প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের নগর অঞ্চলগুলোতে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২০০৫ সালে ৩ কেজি ছিল। কিন্তু ২০২০ সালে সে পরিমাণ ৩ গুণ বেড়ে ৯ কেজি হয়েছে।
ঢাকা শহরে এই পরিমাণ ২২ কেজি ৫০০ গ্রাম, যা জাতীয় গড়ের চেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি। ২০০৫ সালে ঢাকায় মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল ৯ কেজি ২০০ গ্রাম।
আজ সোমবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ‘টুয়ার্ডস এ মাল্টিসেক্টরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ নামক প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু তুলে ধরেন বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বুশরা নিশাত। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পর্কিত নানা তথ্য উঠে আসে।
তিনি বলেন, ‘২০৩০ সাল নাগাদ প্লাস্টিক বর্জ্য ৩০ ভাগ কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করছে বিশ্বব্যাংক। ২০০২ সাল নাগাদ ব্যবহৃত প্লাস্টিকের অর্ধেক পুনঃব্যবহারযোগ্য করে তোলা আমাদের লক্ষ্য’।
বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বুশরা নিশাত অনুষ্ঠান উপস্থাপনার সময় বলেন, ‘ইউরোপের দেশগুলোতে গড় মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ১০০ কেজিরও বেশি, যেটি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। তবে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দূষণের শিকার হওয়া দেশগুলোর তালিকার সবচেয়ে ওপরে থাকা দেশগুলোর অন্যতম এবং প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনাই এর জন্য দায়ী।’
বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর দানদান চেন তার উদ্বোধনী বক্তৃতায় বলেন, ‘দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও নগরায়নের কারণে বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার এবং দূষণ উভয়ই হঠাৎ বেড়ে গেছে। করোনাভাইরাস মহামারি প্লাস্টিক আবর্জনার অব্যবস্থাপনাকে আরও বাড়িয়েছে।’
ইউরোপের দেশগুলোতে গড় মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ১০০ কেজিরও বেশি, যেটি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। তবে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দূষণের শিকার হওয়া দেশগুলোর তালিকার সবচেয়ে ওপরে থাকা দেশগুলোর অন্যতম এবং প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনাই এর জন্য দায়ী।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ক্রমশ বাড়তে থাকা দূষণের হার কমিয়ে সবুজ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতের জন্য প্লাস্টিকের টেকসই ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন।
মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সচেতন নই। যেখানে সেখানে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলি। আমাদের সচেতন হতে হবে। বিদেশে গেলে আমরা নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ফেলি কিন্তু দেশে এসে কেন যেখানে সেখানে ফেলি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে। এসময় তিনি সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান’।
এর আগে গত এপ্রিলে সায়েন্স অ্যাডভান্সে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, সমুদ্রে নদীবাহিত প্লাস্টিক দূষণে শীর্ষ দশ দেশের নয়টিই এশিয়ার।
নেদারল্যান্ডস, জার্মানি ও নিউজিল্যান্ডের সাত গবেষকের করা এই গবেষণা বলছে, সমুদ্রের প্রায় ৮০ ভাগ প্লাস্টিক বর্জ্য আসে পৃথিবীর এক হাজারেরও বেশি নদী থেকে। এর একটি বড় অংশ আসে এশিয়ার নদীগুলো থেকে।
নতুন গবেষণা অনুযায়ী, সাগরদূষণে দায়ী দেশগুলোর যে তালিকা করা হয়েছে, তাতে দেখা গেছে শীর্ষ দশে ব্রাজিল ছাড়া বাকি সব দেশ এশিয়ার। শীর্ষ ৫০টি নদীর মধ্যে এশিয়ার আছে ৪৪টি। এর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার জনবহুল এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া পাসিগ নদী দূষণের তালিকায় সবার ওপরে। এই নদী বছরে প্রায় ৬৯ হাজার টন প্লাস্টিক বহন করে সাগরে নিয়ে যাচ্ছে। দেশটি বছরে মোট ৩ লাখ ৬০ হাজার প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ফেলে। তালিকায় দ্বিতীয় ভারত ও তৃতীয় অবস্থানে আছে চীন। ভারতের নদীগুলো বছরে ১ লাখ ৩০ হাজার টন বর্জ্য সমুদ্রে নিয়ে যায়। চীন তৈরি করে প্রায় ৭১ হাজার টন।
তালিকায় ৯ নম্বরে থাকা বাংলাদেশের নদীগুলো বছরে প্রায় ২৫ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে নিয়ে যায়। বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশের গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা বেসিন, কর্ণফুলী ও রূপসা নদী থেকে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য যায় বঙ্গোপসাগরে। পদ্মা দিয়ে বছরে প্রায় সাত হাজার টন, কর্ণফুলী দিয়ে প্রায় তিন হাজার টন এবং রূপসা দিয়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ে।
শীর্ষ দশে এসব দেশ ছাড়াও নাম আছে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের। শুধু এই দেশগুলোই বছরে প্রায় ৫ লাখ ৮০ হাজার টন বর্জ্য ফেলে সমুদ্রে। আশার কথা হলো, সমুদ্র পরিষ্কার করার জন্য এখন পৃথিবীতে অনেকগুলো সংস্থা কাজ করছে। তারা প্রচুর অর্থও সেখানে ব্যয় করছে। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, শুধু পরিষ্কার করাই সমাধান হতে পারে না। জনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো দিয়ে যেসব নদী বয়ে গেছে, সেসব এলাকায় পানিতে প্লাস্টিক বর্জ্য যেন না ফেলা হয় তেমন উদ্যোগ নিতে হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিতে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের ওপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা পালনে দেশের জনগণকে সম্পৃক্ত করা দরকার।
তারা বলেন, সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ প্রশাসন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সততা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এবং জবাবদিহিতার অভাব ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে বর্তমানে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। একইসঙ্গে রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলা।
তারা বলেন, ‘আগামী বছরগুলোতে প্লাস্টিকের ব্যবহার কি বাড়বে? আমরা অনায়াসে বলতে পারি বাড়বে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে হাত মিলিয়েই বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। তারা বলেন, অর্থনীতিতে যত বেশি প্রবৃদ্ধি আসছে প্লাস্টিকের ব্যবহারও বাড়ছে। প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে নির্মাণে, অবকাঠামো উন্নয়নে, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস শিল্পে এবং পরিবহনে।
তারা বলেন, আপনার ছোট ছোট পদক্ষেপে সমুদ্র দূষণ কমতে পারে। সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং চারপাশের মানুষকেও সমুদ্রের গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে হবে। সমুদ্রে বেড়াতে গেলে আমরা জেনে বা না বুঝে বিভিন্ন খাবারের প্যাকেটসহ বোতল বা প্লাস্টিক ইত্যাদি পানিতে ফেলে দূষিত করি। এবিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৩
আপনার মতামত জানানঃ