মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ড্রোন হামলাকে ‘ব্যাপক ত্রুটিপূর্ণ’ বলে পেন্টাগন এক গোপন নথিতে জানিয়েছে। পেন্টাগনের ওই গোপন নথিতে বলা হয়েছে, ২০১৪ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ড্রোন হামলায় সহস্রাধিক বেসামরিক নাগরিকের নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। পেন্টাগনের গোপন নথি অনুযায়ী, এসব ‘ভুল হামলায়’ গত এক দশকে মধ্যপ্রাচ্যে ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমসের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে বলে আল জাজিরা রোববার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে।
পেন্টাগনের গোপন নথিতে বলা হয়েছে, মার্কিন ড্রোন হামলার কারণে সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানে প্রাণ হারিয়েছেন সহস্রাধিক বেসামরিক মানুষ। এসব হামলা থেকে শিশুরাও রেহাই পায়নি।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি ঘটনাতেও ভুল স্বীকার বা কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। অল্প কিছু ঘটনায় নিহতের স্বজনদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। যদিও গত পাঁচ বছরের কিছু বেশি সময় ধরে মার্কিন বাহিনী যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় ৫০ হাজারের বেশি হামলা চালিয়েছে।
পত্রিকাটির তদন্তে দেখা গেছে, বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে একটি ছিল ২০১৬ সালের জুলাইয়ে উত্তর সিরিয়ার একটি গ্রামে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর বোমা হামলায় মৃত্যুর ঘটনা। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) তিনটি লক্ষ্যবস্তুতে হামলায় ৮৫ জঙ্গি নিহত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে দাবি করা হয়। তবে দেখা গেছে, সেখানে ১২০ জন কৃষক ও গ্রামবাসীর মৃত্যু হয়।
একই ঘটনা ঘটেছে ইরাকেও। ২০১৭ সালে ইরাকের পশ্চিম মসুলে মার্কিন বিমান থেকে একটি গাড়ি লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। মার্কিন বাহিনীর দাবি অনুযায়ী, গাড়িটিতে বোমা ছিল। কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধান বলছে, সেই তথ্য সঠিক ছিল না। হামলার সময় গাড়িটিতে মাজিদ মাহমুদ আহমেদ নামের এক ব্যক্তি, তার স্ত্রী ও দুই সন্তান ছিলেন। হামলায় তারা সবাই নিহত হন। প্রাণ যায় আরও তিনজন বেসামরিক ব্যক্তির।
২০১৫ সালের নভেম্বরে, এক ব্যক্তিকে ‘অজ্ঞাত একটি ভারী বস্তু’ আইএসের ‘প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের অবস্থানে’ টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। এর পরপর, আমেরিকান বাহিনী ইরাকের রামাদিতে একটি ভবনে বোমা হামলা চালায়। সামরিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অজ্ঞাত বস্তুটি আসলে ‘ছোট আকারের এক ব্যক্তি’—একটি শিশু ছিল। হামলায় সে নিহত হয়েছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আইএসের বিরুদ্ধে বোমা হামলায় মার্কিন বাহিনী বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষার বিষয়টি নিয়মিতভাবেই পাশ কাটিয়ে গেছে। গত আগস্টে আফগানিস্তানের কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আত্মঘাতী বোমা হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন হামলা চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা করে। পেন্টাগন থেকে শুরুতে দাবি করা হয়েছিল, তারা বোমা বহনকারী একটি গাড়িতে হামলা চালিয়েছে। তবে নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, নিহত ১০ জন বেসামরিক মানুষ। একই পরিবারের সদস্য।
মার্কিন ড্রোন হামলার কারণে সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানে প্রাণ হারিয়েছেন সহস্রাধিক বেসামরিক মানুষ। এসব হামলা থেকে শিশুরাও রেহাই পায়নি।
এ ঘটনায় অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ভুল স্বীকার করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শত শত মৃত্যু ছাড়াও মার্কিন হামলায় বেঁচে যাওয়া অনেক বেসামরিক নাগরিক পঙ্গু হয়ে পড়েন। তাদের ব্যয়বহুল চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কিন্তু অনেক ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র শোক প্রকাশও করেনি।
এ ব্যাপারে ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ডের মুখপাত্র ক্যাপ্টেন বিল আরবান বলেন, ‘বিশ্বের সেরা প্রযুক্তিতেও ভুল হয়। সেটা অসম্পূর্ণ তথ্যের কারণে কিংবা প্রাপ্ত তথ্যের ভুল ব্যাখ্যার কারণেও হতে পারে। আমরা সেই ভুলগুলো থেকে শেখার চেষ্টা করি। আমরা প্রতিটি বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা তদন্ত করি এবং প্রতিটি নির্দোষ জীবনের ক্ষতির জন্য অনুতপ্ত।’
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনের শেষ বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বিমান অভিযান দ্রুত বৃদ্ধি পায়। পেন্টাগন তাদের প্রযুক্তি নিয়ে দম্ভ করে বলেছিল, নতুন প্রযুক্তিতে শত্রুযোদ্ধায় ভরা একটি বাড়ির একটি অংশ ধ্বংস করার সময় অবশিষ্ট কাঠামোটি দাঁড়িয়েই ছিল।
মাত্র পাঁচ বছরে মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়ায় অর্ধলক্ষাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে। টাইমসের সাংবাদিকরা প্রতিবেদনটি তৈরি করতে ১০০টিরও বেশি হতাহতের স্থান পরিদর্শন; বেঁচে থাকা বাসিন্দাদের এবং বর্তমান ও সাবেক আমেরিকান কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন।
উল্লেখ্য, ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধরত মার্কিন সেনাদের মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় তুমুল সমালোচনার মুখে পড়তে হয় যুক্তরাষ্ট্রকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে মধ্যপ্রাচ্যে বিমান হামলা ব্যাপকতা পায়। ধীরে ধীরে দেশগুলো থেকে সেনা কমিয়ে ড্রোন হামলা বাড়িয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বারাক ওবামা এসব বিমান হামলাকে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে নিখুঁত অভিযান’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলেও এসব হামলা অব্যাহত ছিল।
এদিকে কদিন আগে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা আগস্টে ড্রোন হামলা চালিয়ে সাতটি শিশুসহ ১০ জন বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যেসব সেনা সদস্য জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না। এক্ষেত্রে শুধু শৃংখলাভঙ্গের অভিযোগ আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন। নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়াকে উদ্ধৃত করে এ খবর দিয়েছে অনলাইন আল জাজিরা। এতে বলা হয়েছে, ওই ড্রোন হামলার বিষয়ে আভ্যন্তরীণ একটি পর্যালোচনা করেছে পেন্টাগন।
তাতে বলা হয়েছে, ২৯ শে আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানীতে বোমা হামলা যুদ্ধের আইন লঙ্ঘন করেনি। এটি কোনো অসদাচারণ নয় অথবা ফৌজদারি অবহেলাও নয়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী অস্টিনের সিদ্ধান্ত প্রথম প্রকাশ করে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
এতে সূত্র হিসেবে পেন্টাগনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর দু’জন কমান্ডারকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সুপারিশ করেছেন যাতে ওই হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়া হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪২
আপনার মতামত জানানঃ