দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। যদিও ভারতীয় বাহিনী এ যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়েছিল একেবারে শেষের দিকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। অথচ ভারতে এখন অনেকেই ১৯৭১ সালের এ যুদ্ধকে নিতান্তই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করতে পছন্দ করেন।
এদিকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারতের যুদ্ধ’ এবং সেই যুদ্ধে ‘ভারত জয়ী’ হয়েছিল বলে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং।
রবিবার (১২ ডিসেম্বর) দেশটির রাজধানী নয়াদিল্লির ইন্ডিয়া গেটে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় এবং ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বের ৫০ বছর স্মরণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই মন্তব্য করেন তিনি।
রাজনাথ বলেন, ‘আজকের দিনে আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যেক সৈন্যের সাহসিকতা, বীরত্ব এবং আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধা জানাই। যার কারণে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারত জয়ী হয়। ভারত সবসময় সেই সব সাহসী হৃদয়ের আত্মত্যাগকারী সৈন্যদের কাছে ঋণী থাকবে।’
ভারতের এই প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘মাঝে মাঝে আমি এই ভেবে বিস্মিত হয়ে যাই যে, আমাদের বাঙালি বোন-ভাইদের কী দোষ ছিল? নিজেদের অধিকারের দাবি দোষের? তাদের শিল্প, সংস্কৃতি এবং ভাষা রক্ষা করতে চাওয়াটা দোষের? রাজনীতি এবং শাসন ব্যবস্থায় নিজেদের প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে কথা বলাটা দোষের?’
তিনি বলেছেন, ‘আমাদের বাঙালি বোন-ভাইদের ওপর অবিচার এবং নৃশংসতা কোনো না কোনোভাবে সমগ্র মানবতার জন্য হুমকি ছিল। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের রাজধর্ম, রাষ্ট্রধর্ম এবং সামরিক ধর্মই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে সেই অন্যায় ও শোষণ থেকে মুক্ত করতে সাহায্য করেছিল।’
রাজনাথ সিং বলেন, এই যুদ্ধ আমাদের নৈতিকতা, আমাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য এবং ন্যায্যতার এক সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, যুদ্ধে অন্য দেশকে পরাজিত করার পর আমাদের মতো একটি দেশ তার ওপর আধিপত্য বিস্তার করেনি। বরং সেই দেশের রাজনৈতিক প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে।’
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি জয় পেয়েছে ভারত। এবার পাকিস্তান-প্ররোচিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চলমান পরোক্ষ যুদ্ধেও ভারত বিজয়ী হবে।
তিনি আরো বলেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধ এটাই দেখিয়ে দিয়েছে যে, ব্রিটেনের শাসন থেকে স্বাধীনতাকালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতভাগ ছিল এক ঐতিহাসিক ভুল।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের বিজয় উদযাপনের ‘স্বর্ণিম বিজয় পর্ব’ অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী বক্তব্যে রাজনাথ সিং আরো বলেন, সন্ত্রাস ও অন্য ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে ভারতকে ভাঙতে চায় পাকিস্তান। কিন্তু ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতের সেনাবাহিনী তাদের সব রকম পরিকল্পনাকে পরাজিত করেছিল। বর্তমানে তারা সন্ত্রাসের মূলোৎপাটনের জন্য কাজ করছে। রাজনাথ সিং বলেন, আমরা সরাসরি যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি। আমি পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, পরোক্ষ যুদ্ধেও আমরা বিজয়ী হবো।
তিনি জানান ‘স্বর্ণিম বিজয় পর্ব’ আরো জাকজমকপূর্ণভাবে পালন করার পরিকল্পনা নিয়েছিল ভারত সরকার।
কিন্তু যেহেতু দেশের প্রথম চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) জেনারেল বিপিন রাওয়াত, তার স্ত্রী ও সশস্ত্র বাহিনীর আরো ১১ জন অকালে নিহত হয়েছেন, তাই এই অনুষ্ঠান সাধারণভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি জয় পেয়েছে ভারত। এবার পাকিস্তান-প্ররোচিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চলমান পরোক্ষ যুদ্ধেও ভারত বিজয়ী হবে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জয় এবং ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বের ৫০ বছর স্মরণে নয়াদিল্লির ইন্ডিয়া গেটে দু’দিন ব্যাপী ‘স্বর্ণিম বিজয় পর্ব’ উদযাপন শুরু হয়েছে। রবিবার ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ব্যবহৃত প্রধান প্রধান অস্ত্র এবং অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জামও সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে।
আগামীকাল সোমবার ‘স্বর্ণিম বিজয় পর্ব’ উদযাপনের সমাপনী অনুষ্ঠিত হবে। সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি প্রতিনিধিদের পাশাপাশি রাজনাথ সিং ও অন্যান্যরা উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
এর আগে গতবছর ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় দিবসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের অসীম সাহসিকতাকে স্মরণ করে টুইট করেন। কিন্তু তার টুইটে যেমন আসেনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তেমনি ওই টুইটে যে অসংখ্য ভারতীয় মন্তব্য করেছেন তাতেও প্রায় সবাই ওই যুদ্ধকে চিত্রিত করেছেন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধ হিসেবে।
কয়েক বছর আগে বলিউডে গুন্ডে নামের একটি সিনেমায় একাত্তরের যুদ্ধকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ না বলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে বর্ণনা করা নিয়ে তুমুল শোরগোল হয়েছিলো। বিশেষ করে তীব্র প্রতিবাদ উঠেছিলো বাংলাদেশীদের তরফ থেকে।
বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতীয়দের অনেকে এখন যেভাবে ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে চিত্রিত করছেন সেটি ইতিহাসের ভুল। কারণ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ছিলো না, সেটি বরং বাংলাদেশ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন ভারত তাতে সামিল হয়েছিলো।
তারা বলেন, এটি সত্যি যে ভারতীয়দের অনেকে এখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলেন। কিন্তু আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। তাই আত্মদান করেছি। ভারত তাতে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণই আত্মত্যাগ করে বিজয়ের পটভূমি তৈরি করেছিল। এটি না হলে ভারত জয়ী হতো না এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনও পেতোনা।
আরও বলেন, এর সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বও একমত পোষণ করলে বুঝতে হবে যে অনেকে যে অভিযোগ করেন ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নয় বরং পাকিস্তানকে ভাঙার জন্য ওই লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলো সেটিই সত্য বলে প্রমাণিত হবে।
তারা বলেন, ভারতের সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো এটি সত্যি কিন্তু বিজয়ের ভিত রচনা করেছিল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। তাদের মতে এর বাইরে গিয়ে ওই যুদ্ধ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনার চেষ্টা হলে তা দু’দেশের জনগণের মধ্যেও ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৮
আপনার মতামত জানানঃ