পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগে শ্রীলঙ্কার এক নাগরিককে পিটিয়ে হত্যা করার রেশ এখনো যায়নি। এরইমধ্যে আরেকটি ঘটনায় তোলপাড় পাকিস্তান। পাকিস্তানের একটি মার্কেটে চার নারীকে বেধড়ক মারপিটের পর বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ ঘিরে দেশটিতে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি করেছে। ঘটনাটি ঘটেছে দেশটির পাঞ্জাব প্রদেশের ফয়সালাবাদে। সেই ঘটনার ভিডিও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে এনডিটিভি।
সোমবার ফয়সালাবাদের বাওয়া চক মার্কেটে ওই চার নারীকে মারপিট, বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে একদল দুর্বৃত্ত। মঙ্গলবার ফয়সালাবাদের পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করেছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার নগর পুলিশ কর্মকর্তা (সিপিও) ডা. মোহাম্মদ আবিদ খান। তিনি বলেছেন, অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।
এর আগে, সোমবার নির্যাতনের শিকার একজন নারী ফয়সালাবাদের মিল্লাত পুলিশ স্টেশনে চারজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ১০ জনের বিরুদ্ধে একটি এফআইআর দায়ের করেন। এফআইআরে বলা হয়েছে, সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী অন্য তিন নারীর সঙ্গে বাওয়া চক মার্কেটে আবর্জনা সংগ্রহ করতে যান।
পুলিশকে ওই পরিচ্ছনতাকর্মী বলেছেন, তারা তৃষ্ণার্ত ছিলেন এবং মার্কেটের একটি বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বিক্রির দোকানে যান। সেখানে দোকানের এক কর্মীর কাছে এক বোতল পানি চান তারা। এ সময় দোকানের মালিক চিৎকার শুরু করেন। ওই নারীরা চুরির উদ্দেশ্যে দোকানে প্রবেশ করেছেন বলে অভিযোগ তোলেন তিনি। চিৎকার শুনে পরে অন্যান্য দোকানিরাও সেখানে পৌঁছান।
ওই চার নারীকে বেধড়ক মারপিট শুরু করেন দোকানিরা। এক পর্যায়ে তাদের বিবস্ত্র করে মার্কেটের মধ্য দিয়ে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যান তারা। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে তাদের মারধর এবং নগ্ন অবস্থায় ভিডিও ধারণ করে অভিযুক্তরা। পরে সেখানে ওই চার নারীর স্বজন ও পথচারীরা এগিয়ে এসে তাদের মুক্ত করেন।
পাঞ্জাব পুলিশের এক টুইট বার্তায় সোমবার রাতেই সন্দেহভাজন দুই দোকানিকে আটকের তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালের দিকে অপর তিন সন্দেহভাজনকে আটক করেছে দেশটির পুলিশ।
কদিন আগে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের দিন দেশটির পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরে টিকটকের ভিডিও বানাতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে মারাত্মক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে এক নারীকে।
সূত্র মতে, বন্ধুদের সঙ্গে টিকটকের ভিডিও বানাচ্ছিলেন ওই নারী। আচমকা তাদের ওপর হামলে পড়ে কয়েক’শ মানুষ। তারা ওই নারীকে ভয়ংকরভাবে টানাহেঁচড়া করতে থাকে, কয়েকজন তাকে শূন্যে তুলে ফেলে, এমনকি কাপড়-চোপড়ও ছিঁড়ে ফেলা হয়।
শেষ পর্যন্ত প্রাণে বেঁচে গেলেও, ওই নারী শারীরিক ও মানসিকভাবে যে মারাত্মক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তা বর্ণনাতীত।
নারীর জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশের তালিকায় পাকিস্তান বিশ্বে ছয় নম্বরে অবস্থান করছে৷ যৌন নির্যাতন ও পারিবারিক সহিংসতার হার বেড়েই চলেছে দেশটিতে৷ দেশটির অধিকাংশরাই মনে করেন নারীরা অনিরাপদ।
২০০২ সালে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়া অধিকারকর্মী মুখতার মাই-এর মতও একই৷ তিনি বলেন, যারা নারীর প্রতি সহিংসতা করে, তারা আইনি প্রক্রিয়াকে ভয় করে না৷
তিনি জানান, বেশিরভাগ পাকিস্তানি পুরুষ নারীকে পেটানোকে কোনো সহিংসতাই মনে করে না৷ পাকিস্তানি সমাজ এখনও সামন্তবাদী এবং গোত্রবাদী প্রথা থেকে বের হতে পারেনি বলেও মনে করেন তিনি৷
সমাজের পুরুষতান্ত্রিক আচরণকেও দায়ী করেন অনেকে৷ লাহোর-ভিত্তিক নারীবাদী আন্দোলনকারী মাহনাজ রেহমান বলেন, যখনই নারীরা তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয় তখনই তাদের সহিংসতার শিকার হতে হয়৷
তিনি বলেন, নারীদের শিক্ষা দেয়া হয় পুরুষকে মান্য করে চলার জন্য, কারণ, পরিবারে তাদের স্ট্যাটাস উঁচুতে৷
লাহোর-ভিত্তিক অ্যাক্টিভিস্ট সাজিয়া খান মনে করেন, কিছু কিছু পুরুষ ধর্মীয় শিক্ষার কারণে নিজেদের আলাদা ভাবতে শুরু করেন৷ তিনি বলেন, আলেমরা এমনভাবে ধর্মের ব্যাখ্যা দেন যে পুরুষরা মনে করে তারা নারীদের পেটাতেই পারে৷ তারা বাল্যবিয়েও সমর্থন করে এবং নারীদের বলে, স্বামী মারধর করলেও তাকে মেনে চলতে৷
অনেক অধিকারকর্মীই দেশটির প্রধানমন্ত্রী ‘সহিংসতার শিকার নারীকেই উলটো দায়ী’ করার কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে বলে মনে করেন৷
চলতি বছরের মাঝামাঝিতে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যৌন নির্যাতনের জন্য নারীকেই দায়ী করে বক্তব্য দিয়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেন৷ মার্কিন টিভি চ্যানেল এইচবিওতে ডকুমেন্টারি নিউজ সিরিজ এক্সিওস-এর জন্য দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, নারী যদি খুব কম কাপড় পরে তাহলে পুরুষের ওপর তার প্রভাব পড়তেই পারে, যদি তারা রোবট না হয়৷ এটাকে ‘সাধারণ জ্ঞান’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি৷
এ বছরের শুরুতেও একটি মতবিনিময় অনুষ্ঠানে পাকিস্তানে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনে ‘পর্দার’ অভাবকে দায়ী করে বক্তব্য দেন তিনি৷
অধিকারকর্মীরা বলেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং তার মন্ত্রীদের একের পর এক নারীবিরোধী মন্তব্য নারীবিদ্বেষ এবং নারীর প্রতি সহিংসতাকেও এক প্রকার উসকে দিয়েছে৷
তারা মনে করেন, ইমরান খানের সরকার নারীদের রক্ষায় কিছুই করেনি৷ বরং নারীর প্রতি সহিংসতা দমনে একটি আইন দেশের ইসলামিক আলেমদের কাছে পাঠানোর পর তারা তা আটকে দিয়েছেন৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ