দেশে প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর আহরণ আগের চেয়ে বেড়েছে, কিন্তু তা প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ছে না। নির্ধারিত সময় (৩০ নভেম্বর) পেরিয়ে গেলেও ৭৯ শতাংশ করদাতা আয়কর রিটার্ন দাখিল করেননি। সংখ্যার হিসাবে যার পরিমাণ ৫৫ লাখ ৫০ হাজার ৪৬৯। মাত্র প্রায় ২১ শতাংশ টিআইএনধারী করদাতা রিটার্ন দাখিল করেছেন।
এনবিআর থেকে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, মঙ্গলবার পর্যন্ত রিটার্ন দাখিল করেছেন ১৪ লাখ ৪৯ হাজার ৫৩১ জন করদাতা। এছাড়া সময় বৃদ্ধি আবেদন জমা পড়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪৮৬টি। যার বিপরীতে আয়কর এসেছে ১ হাজার ২৫০ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
ই-টিআইএন রেজিস্ট্রেশন করা করদাতা ৭০ লাখের বেশি। অথচ ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৫৫ লাখ ৫০ হাজার ৪৬৯ করদাতা রিটার্ন দাখিল করেননি। যদিও সময় বৃদ্ধির আবেদন ও রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা যোগ করলেও ১৬ লাখ ৬ হাজার ১০৭ জন করদাতা রিটার্ন দাখিল করেছেন বা রিটার্ন দাখিলে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ বাকি ৫৩ লাখ ৯৪ হাজার ৯৮৩ করদাতা হিসাবের বাইরে রয়েছেন।
যদিও এনবিআরের আয়কর বিভাগ মনে করে, চূড়ান্ত হিসাবে রিটার্ন দাখিলকারীর সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। এছাড়া নতুন করে সময় বৃদ্ধি ও জরিমানা দিয়ে রিটার্ন দাখিলের আবেদন বিবেচনা করলে জানুয়ারি মাস গিয়ে রিটার্ন দাখিল ২৫ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এর আগে ব্যবসায়ী ও করদাতাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) রাতে আয়কর রিটার্ন দাখিলের শেষ দিনে জমা দেওয়ার সময় আরও এক মাস বৃদ্ধি করে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করার ঘোষণা আসে। এনবিআরের পরিচালক (জনসংযোগ) সৈয়দ এ মু’মেন এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
করোনা মহামারি বিবেচনায় চলতি বছরে আয়কর মেলা না হলেও এনবিআরের আওতাধীন সারাদেশে ৩১টি কর অঞ্চলে ১ নভেম্বর থেকে মেলার মতো সেবা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি কর অঞ্চলে জোন ভিত্তিক বুথ, ই-টিআইএন ও তথ্য সেবা বুথ রাখা হয়েছে। ৩০ নভেম্বর কর অঞ্চলগুলোতে করদাতাদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। তাই করসেবায় রাত ৮টা পর্যন্ত কর অফিসগুলো খোলা রাখা হয়েছিল।
একই দিন আয়কর দিবস হওয়ায় এনবিআরসহ প্রতিষ্ঠানটির ৩১টি কর অঞ্চলের অফিসগুলো সজ্জিত করা হয়। যদিও চলমান বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে জনসমাগমের ঝুঁকি বিবেচনায় আয়কর দিবসে র্যালি করেনি এনবিআর।
এর আগে ২০২০-২১ করবর্ষে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২০ লাখ ৪২ হাজার করদাতা আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছিলেন। তখন রিটার্ন দাখিলের জন্য অতিরিক্ত সময় চেয়ে আবেদন জমা পড়ে ১ লাখ ৫০ হাজারটি। যদিও সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে ২৪ লাখ করদাতার আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছিলেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরিসংখ্যান মতে, গত অর্থবছরে কর আদায় হয় প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট রাজস্বের প্রায় ৩৩ শতাংশ।
ই-টিআইএন রেজিস্ট্রেশন করা করদাতা ৭০ লাখের বেশি। অথচ ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৫৫ লাখ ৫০ হাজার ৪৬৯ করদাতা রিটার্ন দাখিল করেননি। যদিও সময় বৃদ্ধির আবেদন ও রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা যোগ করলেও ১৬ লাখ ৬ হাজার ১০৭ জন করদাতা রিটার্ন দাখিল করেছেন বা রিটার্ন দাখিলে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ বাকি ৫৩ লাখ ৯৪ হাজার ৯৮৩ করদাতা হিসাবের বাইরে রয়েছেন।
আয় অনুপাতে কর দেয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশে কতজনের আছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। এনবিআর এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো জরিপ করেনি। তবে ধারণা করা হয়, সামর্থ্যবান বেশির ভাগ এখনও করের আওতার বাইরে।
বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইডের ২০১৬ সালের এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৬৯ লাখ লোকের কর দেয়ার সামর্থ্য রয়েছে। আর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার প্রথম বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে অন্তত ৪ কোটি লোক কর দেয়ার সামর্থ্য রাখে।
বিশেষজ্ঞসহ অর্থনীতিবিদদের মতে, এ দেশে যোগ্য করদাতা কমপক্ষে ৩ কোটি।
বিত্তবানদের সংখ্যা বাড়লেও তাদের কাছ থেকে খুব কমই কর আদায় হয়। আইন অনুযায়ী, বাড়িগাড়িসহ ৩ কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে নিয়মিত আয়করের সঙ্গে অতিরক্তি কর দিতে হয়, যা ‘সারচার্জ’ নামে পরিচিত।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৩ কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে, দেশে এমন করদাতার সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। অর্থাৎ মাত্র ১৫ হাজার লোক সারচার্জ দিতে সাড়া দিয়েছেন। পরিসংখ্যানে বলে, সামর্থ্যবানদের মাত্র দশমিক ২৫ শতাংশ সারচার্জ দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে কোটিপতির সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১ কোটি টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা বেড়েছে এমন বিত্তবানের সংখ্যা ৭৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
কোটিপতির সংখ্যা বাড়লেও এদের অনেকেই করের আওতার বাইরে।
রাজস্ব বোর্ডের সবশেষ হিসাবমতে, দেশে করদাতা শণাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএনধারীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। এর মধ্যে আয়কর রিটার্ন জমা দেন মাত্র ২৫ লাখ। অর্থাৎ ৬৪ ভাগই রিটার্ন জমা দেন না।
যারা রিটার্ন জমা দেন, তারা সবাই কর দেন না। এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, ‘শূন্য’ অর্থাৎ কোনো কর আসে না এমন সংখ্যা মোট জমা পড়া রিটার্নের ১৫ শতাংশ। সে হিসাবে নিয়মিত করদাতার সংখ্যা সর্বোচ্চ ২০ লাখের মতো। অর্থাৎ ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে ১ শতাংশেরও কম ব্যক্তি কর দেন।
সক্ষম জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ করের আওতার বাইরে থাকাকে এ দেশের কর-সংস্কৃতির বড় দুর্বলতা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই হার মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। তাদের অর্ধেকই করের আওতার বাইরে। শ্রমশক্তির প্রায় ৬০ ভাগই কৃষিনির্ভর।
তবে কৃষি থেকে অর্জিত আয় করমুক্ত। বড় একটি অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের চাকুরে। তাদের কাছ থেকেও কর আসে মাত্র ৩ থেকে ৫ শতাংশ। আবার রপ্তানি ও শিল্প খাতে আছে কর মওকুফ সুবিধা। এ ছাড়া আয় গোপন করে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দেয়া হয়। রয়েছে কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অদক্ষতা। সব মিলিয়ে মোট জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশের করযোগ্য আয় নেই কিংবা তারা কর আদায়ের আওতার বাইরে। তাই প্রত্যাশা অনুযায়ী আয়কর আদায় হচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, ব্যক্তি ও কোম্পানি— এ দুই শ্রেণির করদাতা থেকে আয়কর আদায় হয়। এর মধ্যে মোট আয়কর আদায়ের ৬০ শতাংশ আসে কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান থেকে। বাকি ৪০ শতাংশ ব্যক্তি শ্রেণির কর, যদিও সংখ্যার দিক থেকে ব্যক্তি শ্রেণি করদাতার সংখ্যাই বেশি। কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম হলেও এ খাত থেকেই বেশি কর আদায় হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, সংবিধানের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের গুরুত্ব, মর্যাদা ও অধিকার সমান। প্রত্যেক নাগরিকের জন্য বিভিন্ন সেবা নিশ্চিত করা যেমন রাষ্ট্রের কাজ, তেমনি ন্যায্যতার ভিত্তিতে কর আদায় করাটাও রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য দায়িত্ব। একটি রাষ্ট্রের করব্যবস্থা কতটা ন্যায্য, তার ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের চরিত্র। রাষ্ট্র কতটা সুশীল, কতটা কল্যাণমুখী ও মানবিক তা অনেকাংশেই নির্ভর করে সেই দেশের মানুষ কতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর দেয়, বিনিময়ে তারা কতটা রাষ্ট্রীয় সেবা পায় তার ওপর। সামর্থ্য অনুযায়ী নাগরিকদের কাছ থেকে যেমন কর আদায় করতে হবে, সেই সঙ্গে করের টাকার যেন অপচয় না হয়, সাধারণ মানুষ যেন সরকারি সেবাগুলো সহজে পায়, পাশাপাশি করের ভারে জর্জরিত না হয়ে পড়ে, এসব নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
কিন্তু দেখা যায় আমাদের দেশের কর ব্যবস্থা ন্যায্যতার ভিত্তিতে পরিচালিত হয় না। বড়লোকরা নানাভাবে কর ফাঁকি দেয়। আবার তাদের জন্য রয়েছে কর রেয়াতের নানা ব্যবস্থা। পক্ষান্তরে গরিবদের প্রতিনিয়ত পরোক্ষ করের বোঝা বইতে হয়। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বঞ্চিত থাকে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ফাঁকি রোধ করতে পারলে, আদায় প্রক্রিয়া আরও সহজ হলে, করবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে এবং সর্বোপরি কর বিভাগকে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশনের আওতায় আনা গেলে আরও ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি কর আহরণ করা সম্ভব। বাস্তবতা হচ্ছে, এ সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৪
আপনার মতামত জানানঃ