জন্মের পর জিনগত ক্রুটির শিকার হয় অনেক শিশুই। পরবর্তীকালে তাদের শরীরে নানা অস্বাভাবিক লক্ষণও ফুটে ওঠে। জিনগত ক্রুটির পরিণাম এতটাই মারাত্মক হতে পারে যে, গর্ভপাতেরও সিদ্ধান্ত নেন অনেক দম্পতি। কিন্তু, তা বলে জিনগত ক্রুটির কারণে শিশুর লিঙ্গটাই পালটে যাবে? বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছনোর পরই নারীশরীরে গজিয়ে উঠবে পুরুষাঙ্গ? এমনই অবিশ্বাস্য ঘটনায় এখন খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জের একটি অখ্যাত গ্রাম।
বিভিন্ন সময় মাঝেমধ্যেই আমরা খবরের কাগজ কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় দেখি, ছেলে হয়ে জন্মে পরবর্তীতে মেয়েতে রুপান্তর হওয়া অথবা মেয়ে হয়ে জন্মে ছেলেতে রুপান্তর! এমন ঘটনা সাধারণ কালেভেদেই চোখে পড়ে। কিন্তু স্যালিনাস নামক গ্রামে এমন ঘটনা একেবারেই স্বাভাবিক।
ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জের ডোমিনিকান রিপাবলিকের ছোট্ট গ্রাম লাস স্যালিনাস। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত গ্রামটির নাম জানতেন না কেউ। কিন্তু, গ্রামে জন্মানো শিশুদের জিনগত ত্রুটি রাতারাতি বিখ্যাত করে তুলেছে এই ছোট্ট জনপদটিকে। এই গ্রামের শিশুকন্যারা বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছনোর পর ছেলে হয়ে যাচ্ছে! কিশোরীদের শরীরে তৈরি হচ্ছে পুরুষাঙ্গ! একজন বা দু’জন নয়, গত কয়েক বছরে স্যালিনাস গ্রামে এমনই অদ্ভুত জিনগত ক্রুটি নিয়ে জন্মেছে ৯০ জন শিশু।
বিবিসি ও ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এটি নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ পেয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছে, গ্রামটিতে অনেক শিশুই মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছে ধীরে ধীরে তাদের শরীরে ছেলেদের বৈশিষ্ট প্রকাশ পেতে শুরু করে। তাদের আচরণও ছোট থেকেই ছেলেদের মতো থাকে।
ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের ক্যারাবিয়ানের ছোট্ট এক গ্রাম স্যালিনাস। সেখানকার অনেক শিশু-কিশোরের সঙ্গেই এমন ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার জেরে কার্লা নামে ৭ বছরের একটি মেয়ে পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছে কার্লোস।
ঠিক তেমনই এক কিশোর হলো জনি। বয়ঃসন্ধির আগ পর্যন্ত সবকিছুই তার ঠিকঠাক ছিলো। তার বয়ঃসন্ধির আগ পর্যন্ত পরিবারের কেউই জানতে পারেননি তাদের আদরের ছোট মেয়েটি আসলে মেয়ে নয় বরং ছেলে!
বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছাতেই জনির শরীরে ছেলেদের সমস্ত বৈশিষ্ট প্রকাশ পায়। যা দেখে হতবাক হয়ে পড়েন সবাই। এ রকম ঘটনা জনি কিংবা কার্লোসের সঙ্গেই ঘটেনি আরও অনেকেই এমন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। তবে এমন হওয়ার কারণ কী?
গ্রামবাসীদের অনেকে বিশ্বাস করতেন, গ্রামের ওপর কোনো পুরনো অভিশাপ থাকায় এমনটা ঘটে। কিন্তু বিজ্ঞান ও চিকিৎসকরা বলছে ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, এই শিশুরা বিরল জিনগত রোগ ফাইভ আলফা রিডাকটেজ ডেফিসিয়েন্সিতে আক্রান্ত। ফাইভ আলফা রিডাকটেজ হলো, মানব শরীরের একটি উৎসেচক এবং সেটির ঘাটতি দেখা দিলেই এই রোগটি দেখা দেয়।
শরীরের জিনটি এই উৎসেচক তৈরির নির্দেশ বহন করে থাকে, তার মধ্যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে এই উৎসেচক যথাযথ পরিমাণে উৎপন্ন হয় না বলে মত চিকিৎসকদের।
‘ফাইভ আলফা রিডাকটেজ’ এর কাজই হলো নারী শরীরে পুরুষের বৈশিষ্ট্য বাহক হরমোন টেস্টোস্টেরনের বিপাক ঘটিয়ে তাকে ডিহাইড্রোটেস্টোস্টেরনে পরিণত করা।
গ্রামবাসীদের অনেকে বিশ্বাস করতেন, গ্রামের ওপর কোনো পুরনো অভিশাপ থাকায় এমনটা ঘটে। কিন্তু বিজ্ঞান ও চিকিৎসকরা বলছে ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, এই শিশুরা বিরল জিনগত রোগ ফাইভ আলফা রিডাকটেজ ডেফিসিয়েন্সিতে আক্রান্ত। ফাইভ আলফা রিডাকটেজ হলো, মানব শরীরের একটি উৎসেচক এবং সেটির ঘাটতি দেখা দিলেই এই রোগটি দেখা দেয়।
নারী শরীরে এটাই স্বাভাবিক জৈবিক ক্রিয়া। এর ফলেই পুরুষের বৈশিষ্ট প্রকাশ পায় না ও ওই ব্যক্তি একজন নারী হিসাবে চিহ্নিত হন।
তবে এই উৎসেচকের ঘাটতি দেখা দিলে টেস্টোস্টেরনের বিপাক ঘটিয়ে তাকে ডিহাইড্রো টেস্টোস্টেরনে পরিণত করার জৈবিক ক্রিয়াটি ব্যাহত হয়। ফলে শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমোনের উপস্থিতির জন্য পুরুষের বৈশিষ্ট প্রকাশ পায়।
এই বিরল জিনগত রোগে আক্রান্তদের মধ্যে দেখা গেছে, জিনগতভাবে তারা পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও বয়ঃসন্ধির আগ পর্যন্ত তাদের মধ্যে পুরুষের বাহ্যিক বৈশিষ্ট যেমন- পুরুষের লিঙ্গের বৃদ্ধি, পেশির গঠন ইত্যাদি প্রকাশ পায় না।
ঠিক বয়ঃসন্ধির পর থেকেই তা ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করে। জনি ও কার্লোসের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটিই ঘটেছে। শুধু ক্যারিবিয়ানের স্যালিনাসে নয় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই বিরল জিনগত রোগের প্রকোপ আছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী, জন্মের পর স্বাভাবিকভাবে মেয়ে থেকে ছেলে হয়ে ওঠার এই ঘটনা ‘গুয়েভেডোসেস’ নামেও পরিচিত। এক বিশেষ ধরনের জন্মগত ক্রুটির কারণে এই ঘটনা ঘটে। যারা এই জিনগত ত্রুটির শিকার হয়, জন্মের সময় তাদের শরীরে মেয়ের লক্ষণই থাকে। কিন্তু, বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছনোর পরই ছেলেদের লক্ষণ ফুটে ওঠে।
এমনকী, ১২ বছর বয়সে শরীরে পুরুষাঙ্গও দেখা পাওয়া যায়। এককথায় জন্মানোর সময় শিশুর শরীরে ছেলের লক্ষণগুলি লুপ্ত বা লুকানো অবস্থায় থাকে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মাতৃগর্ভে থাকার সময়ে একটি বিশেষ ধরনের উৎসেচক ভ্রুণের শরীরের পুরুষ যৌন হরমোন তৈরি করে। কিন্তু, এক্ষেত্রে ভ্রুণের শরীরে ওই বিশেষ উৎসেচক অনুপস্থিত থাকে।
তাই মেয়েদের মতো লক্ষণ নিয়েই ওই বিশেষ ধরনের শিশুরা জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু, বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছনোর পর, শরীরে টেস্টোটেরনের মাত্রা বাড়তে শুরু করে এবং ১২ বছর বয়সে তা পুংলিঙ্গে পরিণত হয়।
স্যালিনাস গ্রামের ‘গুয়েভেডোসেস’ –এর শিকার এক শিশু জানিয়েছে, সে মেয়ে হিসেবেই বড় হযেছে। কিন্তু ছোট থেকে মেয়েদের পোশাক পরতে ভাল লাগত না তার। ছেলেদের সঙ্গেই খেলাধুলা করত সে।
তবে স্যালিনাস গ্রামে এই অদ্ভুত ঘটনার কথা এই প্রথম জানা গেল, এমনটা নয়। সাতের দশকে ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জের এই অখ্যাত গ্রামে গিয়ে প্রথম ‘গুয়েভেডোসেস’ রোগটি লক্ষ্য করেন ডক্টর জুলিয়ান ইমপারেতো।
কর্নিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এনডক্রিনলজিস্ট ড. জুলিয়ান ইমপারেতো স্যালিনাস গ্রামের এই ঘটনা সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন। তিনি গুজব শুনে গ্রামটিতে পরিদর্শনে যান। এই বিষয়টি তার নজরে আসে। এরপর পাপুয়া নিউ গিনিরে সাম্বিয়ান গ্রামগুলোতেও এমন ঘটনা দেখা যায়। কারণ এমন ঘটনা পৃথিবীতে ঘটে তবে সেটি লাখে একটি। কিন্তু এখানকার বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন।
ড. ইমপারতো তাদের নিয়ে অনুসন্ধান করে এর পেছনের কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছেন। তিনি বলেছেন, মানব শরীরের একটি এনজাইমের অভাব হলে জেনেটিক পরিবর্তন ঘটে। মাতৃগর্ভে এই এনজাইমের কারণে ছেলে বা মেয়ে নির্ধারিত হয়। মাতৃগর্ভে ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোক উভয়েরই ‘গোনাডস’ নামে একটি হরমোন থাকে। এটিই মূলত দুই পায়ের মাঝে একটি মাংসপিণ্ড সৃষ্টি করে থাকে। তখনই নির্ধারিত হয় ছেলে বা মেয়ে।
ড. জুলিয়ান ইমপারেতো বলেছেন, মাতৃগর্ভেই যেটি হওয়ার কথা ছিলো সেটি ১২ বছর পরে ঘটছে। এই সময় তাদের কণ্ঠ ভারি হয়ে আসছে এবং পুরুষাঙ্গও চলে আসছে। এভাবেই একটি মেয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে ছেলেতে। এখানে একটি প্রশ্ন আসতে পারে। আর তা হলো তাহলে ছেলেগুলো কেনো মেয়েতে রূপান্তরিত হচ্ছে না? অবশ্য এর কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। তবে ১২ বছরে এটি ঘটলেও ৭/৮ বছর বয়স হতেই তারমধ্যে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এটি সম্পন্ন হয় ১২ বছর বয়স অবধি। তাই ১২ বছর বয়সকেই চিহ্নিত করা হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ