সমুদ্র, নদী, পাহাড়ের মেলবন্ধন রয়েছে চট্টগ্রামে। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যের নগরীর পাহাড়গুলো একে একে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী ভূমিপুত্রদের কুনজরে হারিয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ পাহাড়। কেউ কাটছে কৌশলে, কেউ কাটছে দিনদুপুরে কিংবা রাতে। দিনের পর দিন সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে পাহাড় কাটলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় এখনো বন্ধ হয়নি অবৈধভাবে পাহাড় কাটা। পরিবেশকর্মীরা বারবার বিষয়টি প্রশাসনের নজরে এনে পাহাড় কাটা বন্ধের আহ্বান জানালেও এ বিষয়ে নিয়মিত অভিযান ও নজরদারি নেই প্রশাসনের। কেননা এসব পাহাড় কাটার পেছনে রয়েছেন জনপ্রতিনিধি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
চট্টগ্রামে বিভিন্ন সমিতি ও সোসাইটির নামেও চলছে পাহাড় দখল। পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে পার্ক, স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড দখল করেছে ঝিরিও।
পনেরোটি পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয়েছিল বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড। এখন সেই সড়কের দুপাশের বিশাল এলাকাজুড়ে চলছে নির্বিচারে পাহাড় কাটা, লেক ভরাট আর ঝিরি দখল।
পরিবেশবিধ্বংসী এ কাজে নেতৃত্বে দিচ্ছে এই সড়ক নির্মাণের দায়িত্ব পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড। স্পেক্ট্রার সহায়তায় শত শত একর পাহাড় কেটে দখল নিচ্ছে সংঘবদ্ধ বেশ কয়েকটি ভূমিদস্যুচক্র।
বায়েজিদ লিংক রোডের পাঁচ নম্বর ব্রিজ এলাকার স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের প্রকল্প এলাকাটি একসময় সড়ক নির্মাণের জন্য ব্যবহার করা হতো। কিন্তু বর্তমানে তা প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের কাজে ব্যবহার করছে।
ইতোমধ্যেই প্রকল্প এলাকার ১ একর ২০ শতক পাহাড় কেটে করে ফয়’স লেক ভরাটের অভিযোগ উঠেছে স্পেক্ট্রার বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটির পাহাড় কাটা ও লেক ভরাটের প্রমাণ পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের তদন্ত দলও।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মদ মাসুদ হাসান পাটোয়ারী। তিনি বলেন, ‘স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের প্রজেক্ট এরিয়া ভিজিট করে পাহাড় কাটার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত দল। প্রতিষ্ঠানটি বিশাল এলাকাজুড়ে পাহাড় কেটেছে, যা পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে একটি রিপোর্ট জমা দেব।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্ষমতার তুলনায় তাদের আওতাধীন এলাকা অনেক বড়। তাছাড়া নমনীয় পরিবেশ আইন ও যথাযথ তদারকির অভাবও চট্টগ্রামে অবাধে পাহাড় কাটার অন্যতম কারণ। জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন কার্যালয়ে মঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা ৩৭। তার বিপরীতে এখন কর্মরত মাত্র ১২ জন। এ স্বল্প জনবল দিয়ে বন্দরনগরীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পার্বত্য এলাকাগুলো সুষ্ঠুভাবে তদারক করা অসম্ভব। ফলে পাহাড় কাটার পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পাহাড় কাটা ও লেক ভরাট দেখতে সীতাকুণ্ডে যান পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের ডিজিসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে সীতাকুণ্ড উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন রায় পাহাড় কাটা ও লেক ভরাটের দায়ে ৭২ জনের নাম সংবলিত তালিকা পাঠান পরিবেশ অধিদপ্তরে।
ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. রবিউল হক, সমন্বয়কারী কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন দিদারসহ চার ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে এনফোর্সমেন্ট মামলা দায়ের করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
সেই মামলার শুনানিতে আসামিরা জলাধার ভরাট ও পাহাড় কেটে পরিবেশের ক্ষতিসাধনের বিষয়টি স্বীকারও করেন। পরিবেশ অধিপ্ততর তাদের ৫ কোটি ২৩ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে। পাশাপাশি তিন মাসের মধ্যে ভরাটকৃত জলাধার ও কেটে ফেলা পাহাড় পূর্বাবস্থায় অবস্থায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী টিবিএসকে বলেন, ‘স্পেক্ট্রা আমাদের কাছে প্রকল্পের মাটি রাখার জন্য জায়গাটি ব্যবহারের অনুমতি নিয়েছিল। কিন্তু তারা উল্টো পাহাড় কেটেছে। সরেজমিন তদন্তে বিষয়টি উঠে আসার পর আমরা জরিমানা করেছি।’
কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের ওই আদেশের পর আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও স্পেক্ট্রার এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি পরিবেশ অধিদপ্তর। এই সুযোগে করোনাকালেও পাহাড় কেটে সরকারি জমি দখল অব্যহত রাখে প্রতিষ্ঠানটি।
অভিযোগ আছে, স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড শুধু নিজেরা সরকারি জমি দখল করেনি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সড়ক নির্মাণের সুযোগে বিভিন্ন ব্রিকফিল্ড ও আবাসিক এলাকার প্লট নির্মাণে পাহাড় কাটতে সহায়তা করেছে এই প্রতিষ্ঠান। কোটি কোটি টাকা আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেক্ট্রা লিমিটেড এদের হয়ে পাহাড় কেটেছে।
নগরের বায়েজিদ এলাকায় রয়েছে অসংখ্য পাহাড়। কোলাহলপূর্ণ নগরের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব যেন এসব পাহাড়ের উপর। কিন্তু দিনে দিনে বিলীন হচ্ছে বায়েজিদ এলাকার পাহাড়গুলো। রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী, পুলিশের লোকজনের হাতে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে পাহাড়। বিশাল পাহাড় কেটে করা হচ্ছে সমতল। বানানো হচ্ছে ভবন।
রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পাশাপাশি পুলিশের দুই ডজনেরও বেশি সদস্যের হাতে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে বায়েজিদের পাহাড়। রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীদের সঙ্গে যোগসাজশে তারা পাহাড়ের একরের পর একর জমি দখলে নিচ্ছে। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো পরিণত হচ্ছে সমতলে, বসতিতে।
চট্টগ্রাম এলাকায় বর্ষাকালে প্রাণঘাতী ভূমিধস ও কাদার প্রবাহ নেমে আসার প্রধানতম কারণ হলো পাহাড় কাটা। এর বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগের বিষয়ে ঔদাসীন্য রয়েছে। এ ঔদাসীন্য কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন।
সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, থানচি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান থোয়াইহ্লা মং মারমা বান্দরবানের থানচিতে বাড়ি নির্মাণের জন্য অবৈধভাবে এস্কেভেটর দিয়ে মাসখানেক ধরে পাহাড় কাটছেন। প্রায় পাঁচ একর পাহাড়টির অনেকটাই বর্তমানে সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
২০১১ সালে চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা নিয়ে ‘হিল কাটিং ইন অ্যান্ড অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বেশিরভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার মতিঝর্ণা, ষোলশহর এবং ফয়’স লেকে।
১৯৭৬ থেকে ৩২ বছরে চট্টগ্রাম নগর ও আশেপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ১৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয় বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪ দশমিক ০২ বর্গকিলোমিটার। এ সময় ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়। এটা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। নগরের বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালি ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় এসব পাহাড় কাটা হয়। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ কাটা পড়ে পাঁচলাইশে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, চট্টগ্রাম এলাকায় বর্ষাকালে প্রাণঘাতী ভূমিধস ও কাদার প্রবাহ নেমে আসার প্রধানতম কারণ হলো পাহাড় কাটা। এর বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগের বিষয়ে ঔদাসীন্য রয়েছে। এ ঔদাসীন্য কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন।
তারা বলেন, চট্টগ্রামের ঐতিহ্য পাহাড়। কিন্তু প্রশাসন ও বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়হীনতার কারণে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো দিন দিন দখলে গিয়ে বিলাসবহুল প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। কেউ দখল করে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে ভাড়া দিচ্ছে। আবার কেউ আবাসন প্রকল্পের নামে পাহাড় কেটে সুউচ্চ আবাসন ভবন তৈরি করে চড়া দামে বিক্রি করছে।
এ পাহাড়ের ওপর প্রকল্পগুলোর নকশা সিডিএ কিভাবে অনুমোদন দেয়, সেটাই অন্ধকারে রয়ে গেছে। নগরীর সৌন্দর্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পাহাড় সংরক্ষণ করা জরুরি।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, পাহাড় ও বন কাটার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বা পরিবেশ আদালতে মামলা করেই যেন পরিবেশ অধিদপ্তর দায়িত্ব শেষ। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং পাহাড় ধ্বংসকারীদের আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। জরিমানা ছাড়াও পাহাড় বেষ্টনী দিয়ে বনায়ন করতে হবে।
তারা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, সেগুলোতে একই অপরাধ বারবার হলে শাস্তির মাত্রা কয়েক গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পরিবেশ আইনে যদি এমন দুর্বলতা থাকে, তাহলে তা দূর করা এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ দ্রুতই পাহাড়শূন্য হয়ে যাবে, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল বলে কিছু থাকবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৫
আপনার মতামত জানানঃ