নদী, পাহাড়ের মেলবন্ধন রয়েছে বান্দরবানে। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যের পাহাড়গুলো একে একে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী ভূমিপুত্রদের কুনজরে হারিয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ পাহাড়। কেউ কাটছে কৌশলে, কেউ কাটছে দিনদুপুরে কিংবা রাতে। এভাবে পাহাড়ের আশেপাশে পাহাড়ি ভূমিতে তৈরি হচ্ছে একে একে অট্টালিকা।
প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ করে’ হচ্ছে পাহাড় কাটা
স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ করে’ বান্দরবানের রুমা উপজেলার রুমা সাঙ্গু সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে পাহাড় কাটা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে এস্কেভেটর দিয়ে পাহাড়া কাটা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজিব দাশের বিরুদ্ধে। তবে পাহাড় কাটার বিষয়ে কিছু জানে না বলছে প্রশাসন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, গত বৃহস্পতিবার থেকে রাজীব দাশ প্রকাশ্যে এস্কেভেটর দিয়ে রুমা সদরের সাঙ্গু কলেজের সামনে কাটছেন। কেটে ফেলা মাটি চড়া দামে বিক্রির উদ্দেশ্যে কয়েকটি ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্যত্র। রুমা সদরে প্রবেশপথে প্রধান সড়কের পাশে প্রকাশ্যে পাহাড় কাটলেও নীরব ভূমিকা পালন করছে স্থানীয় প্রশাসন।
স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা বলেন, পাহাড়ের জমির মূল্য সমতল ভূমির তুলনায় অনেকাংশে কম। তাই পাহাড়টি কেটে তারা মাটি বিক্রি করে যেমন লাভবান হচ্ছেন, তেমনি পাহাড় কেটে সমতল ভূমিতে পরিণত করে জমির দামও বাড়াচ্ছেন কয়েক গুণ।
পাহাড় কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজীব দাশ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাহাড়টি কেটে মাটিগুলো এলাকার উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই পাহাড়ের মালিক আমিসহ আরও কয়েকজন। পাহাড় কেটে আমার তেমন কোনও লাভ নেই।’
প্রকাশ্যে পাহাড় কাটার বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি-না জানতে চাইলে বান্দরবান পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমি পাহাড় কাটার বিষয়ে কিছু জানি না। এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
লামায় চলছে দেদারছে পাহাড় কাটা
বান্দরবানের লামা উপজেলার আজিজ নগরে চলছে দেদার পাহাড় কাটা। পরিবেশ অধিদফতরসহ স্থানীয় প্রশাসনের কোনো অনুমতি ছাড়াই পাহাড় কাটা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, উপজেলার আজিজ নগর কাটা পাহাড় নামক এলাকায় স্কেভেটর দিয়ে ৫০ ফুট উঁচু পাহাড় কেটে সাবাড় করে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। এ পাহাড়টি বালুকৃত হওয়ায় প্রায় অর্ধ কোটি টাকার বালু বিক্রি করেছে তারা।
স্থানীয় নূরুল আলম জানান, ওই এলাকার মৃত মৌলনা শরীফ উল্লাহর ছেলে হাবিবউল্লাহ পাহাড় কেটে মাটি ও বালু বিক্রি করেছেন।
পাহাড়ের জমির মূল্য সমতল ভূমির তুলনায় অনেকাংশে কম। তাই পাহাড়টি কেটে তারা মাটি বিক্রি করে যেমন লাভবান হচ্ছেন, তেমনি পাহাড় কেটে সমতল ভূমিতে পরিণত করে জমির দামও বাড়াচ্ছেন কয়েক গুণ।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের আজিজ নগর ষ্টেশন থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে পাঁচ একর আয়তনের ৫০ ফুট উঁচু পাহাড় কেটে সমতল করে ফেলা হয়েছে। পাহাড়ের চূড়ায় ও পাদদেশে নানা গাছপালা ছিল। এখন চিহ্নও নেই।
নতুন কৌশলে কাটা হচ্ছে পাহাড়
বান্দরবান জেলা শহরে বিভিন্ন উন্নয়নের কথা বলে নামে-বেনামে বসতিঘর নির্মাণ থেকে শুরু করে নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিতে নতুন কৌশল অবলম্বনের পায়তারা চালাচ্ছে বান্দরবানে একটি সিন্ডিকেট। তারা দিনে না কেটে মধ্যরাতে লোকালয়ে এক নাগাড়ে একের পর এক পাহাড় কেটে সাবাড় করছে চক্রটি। এই চক্রে মূল হোতা মোহাম্মদ ইয়াসিন আহমেদ।
পাহাড় খেকো মোহাম্মদ ইয়াসিন নামে পাহাড় কাটা দায়ের একাধিক মামলাও রয়েছে এবং বছর খানিক আগেই পরিবেশ অধিপ্তদের মামলায় জরিমানার সাব্যস্ত দোষে পাশাপাশি জেলেও ছিলেন। তাদের সিন্ডিকেট দলটি প্রতিনিয়ত পাহাড় কাটার ফলে হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। মাটি হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক স্থায়িত্ব।
জানা গেছে, কনট্রাকের ভিত্তিতে টাকার বিনিময়ে কয়েক দিন আগে রাতে আঁধারে পৌর ক্যচিংঘাটা নতুন পাড়ায় বীর বাহাদুর স্কুল এন্ড কলেজে যাওয়ার পথে রাস্তা পাশে বসতি নির্মাণের জন্য বিশাল পাহাড় কেটে ফেলেছে। তাছাড়া নীলাচল যাওয়া পথে টাইগার পাড়া এক প্রভাবশালী বাগান মালিক কে বিশাল পাহাড়ের টিলা কেটে রাস্তা সু-ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই মাটিগুলো আবার ট্রাকে ভরিয়ে বিভিন্ন জায়গায় টাকার বিনিময়ে মাটি বিক্রি করা হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন ২০১০ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কাটা বা অদৃশ্য করা যাবে না। তারপরও এমন জনবহুল এলাকায় পুরো পাহাড় কেটে ফেলায় সচেতন মহলকে হতবাক করেছে।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, পাহাড় ও বন কাটার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বা পরিবেশ আদালতে মামলা করেই যেন পরিবেশ অধিদপ্তর দায়িত্ব শেষ। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং পাহাড় ধ্বংসকারীদের আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। জরিমানা ছাড়াও পাহাড় বেষ্টনী দিয়ে বনায়ন করতে হবে।
তারা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, সেগুলোতে একই অপরাধ বারবার হলে শাস্তির মাত্রা কয়েক গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পরিবেশ আইনে যদি এমন দুর্বলতা থাকে, তাহলে তা দূর করা এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ দ্রুতই পাহাড়শূন্য হয়ে যাবে, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল বলে কিছু থাকবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৪
আপনার মতামত জানানঃ