চার দশক আগে চট্টগ্রামে ২০০টি পাহাড় ছিল, যার ৬০ শতাংশ, অর্থাৎ ১২০টিই ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে৷ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খালেদ মেসবাহুজ্জামানের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে৷
গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন, চট্টগ্রামে বর্তমানে টিকে থাকা পাহাড় রক্ষায় জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিডিএ সিটি কর্পোরেশন এক হয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার বিকল্প নেই৷ পাহাড় হচ্ছে পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার খুঁটির মতো, যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিহত করার পাশাপাশি মানুষ এবং জীব-বৈচিত্র্যের সুপেয় পানির আধার৷
ক্রমাগত পাহাড় ধ্বংস হয়ে গেলে চট্টগ্রাম মহানগরী পরভূমিতে পরিণত হবে৷ ক্রমবর্ধমান ইট-কংক্রিটের সৃষ্ট উত্তাপ পরিশোধন করার বিকল্প না থাকায় নগরীর তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যাবে৷ পাহাড় কেটে আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবন করে মানুষ আর্থিকভাবে যতটুকু লাভবান হচ্ছে বাস্তবে প্রাকৃতিক ক্ষতির পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি৷
২০০৭ সালে পাহাড় ধ্বসে ১২৯ জন মারা যাওয়ার পর শক্তিশালী পাহাড় রক্ষা কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি৷ পাহাড় রক্ষায় বেলার দায়ের করা মামলায় ২০১২ সালে সুনির্দিষ্ট রায় দেন হাইকোর্ট৷
রায়ে পাহাড় কর্তনকারীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি পাহাড়ে নির্মিত স্থাপনাসমূহ গুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশনা ছিল৷ কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন হাইকোর্টের সেই আদেশ বাস্তবায়ন করেনি৷
কেন বন্ধ হচ্ছে না পাহাড় কাটা?
এরপরও কেন পাহাড় কাটা বন্ধ করা যাচ্ছে না, জানতে চাইলে পাহাড় ও পরিবেশ রক্ষা নিয়ে কাজ করা সংগঠন পিপলস ভয়েস-এর চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, ‘চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা বন্ধ না হওয়ার পেছনের কারণ হচ্ছে মোটা দাগে এখানে বিশাল অংকের বাণিজ্য আছে৷ এই বাণিজ্যের সঙ্গে সবসময় যুক্ত থাকেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা৷
স্থানীয় কোনো কোনো জনপ্রতিনিধিও এর সঙ্গে আছেন৷ আরেকটি কারণ হলো, যারা পাহাড় কাটছেন বা দখল করছেন, তাদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি৷ কারণ, এর সঙ্গে যারা যুক্ত তারা সবসময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকেন৷ এখানে পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন৷ প্রশাসনের যে উদ্যোগ, সেটা আরও বাড়াতে হবে৷
ক্ষমতার দাপটে অন্ধ প্রশাসন
গগ বৃহস্পতিবার পাহাড় কেটে খাল ভরাটের খবর পেয়ে সেখানে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)-র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান৷ তখন তার গাড়িবহরে হামলা হয়৷ হামলায় নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে৷
এরপর রিজওয়ানা হাসান বাদি হয়ে শহরের আকবর শাহ থানার কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন৷ বৃহস্পতিবার রাতে মামলা হলেও শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হননি৷
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, মূলত অবৈধভাবে পাহাড় কাটা এবং কালির ছড়াখাল ভরাট ও স্থাপনা নির্মাণ সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়েছিলাম৷ এ সময় স্থানীয় কাউন্সিলর জসিমের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন৷ আমরা কেন সেখানে গিয়েছি, কোথা থেকে এসেছি এসব প্রশ্ন করতে থাকেন৷’’
আলীউর বলেন, তাদের আক্রমণের প্রস্তুতি দেখে আমরা পাহাড়ের নীচে নামিনি৷ পরে আমরা পথ পরিবর্তন করে বায়েজিদ লিংক রোডের সুপারি বাগান গাউছিয়া হোটেলের সামনে ৫ নম্বর ব্রিজের কাছে অবস্থান নেই৷ এ সময় আমাদের গাড়িটিকে ঘুরিয়ে বায়েজিদ লিংক রোডে আসতে বলা হয়৷
গাড়িটি আসার পথে লেকসিটি আবাসিকের প্রধান গেটে তারা আটকে দেয় এবং অস্ত্রের মুখে সেটিকে আবাসিকের অফিসে নিয়ে যায়৷ তখন রিজওয়ানা আপা আকবর শাহ থানায় ফোন দিলে একটি টিম এসে গাড়িটিকে উদ্ধার করে৷ উদ্ধারের পর গাড়িটিতে আমরা ওঠার সময় কাউন্সিলরের লোকজন ঢিল ছোঁড়ে৷ এতে গাড়িটির ক্ষতি হয়৷
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে খবর পেয়ে আমরা পরিদর্শনে গেলে স্থানীয় কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম নিজেই ঘটনাস্থলে আসেন৷ আমাদের স্থানীয় লোকজন বলেছেন, কাউন্সিলর নিজে পাহাড় কেটে কালির ছড়াখাল ভরাট করছেন৷ সেখানে তিনি প্লট করে বিক্রি করছেন৷
কাউন্সিলর ক্ষমতাবান হওয়ার কারণে স্থানীয়রা তাকে কিছু বলতে পারছেন না৷ শুধু স্থানীয় লোকজনই আমাদের বলেনি, সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর তদন্ত করে কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে স্থানীয় মামলাও করেছে৷ আমাদের দুর্ভগ্য হলো, এই ধরনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, কিন্তু সেটা হচ্ছে না৷ কাউন্সিলরকে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনার কথা, সেটাও হয়নি৷
আমাদের গাড়িটি কাউন্সিলরের লোকজন আটকে রেখেছিল৷ তাদের হাতে দেশীয় অস্ত্র ছিল৷ পরে থানায় ফোন দিলে একদল পুলিশ এসে গাড়ি এবং ড্রাইভারকে উদ্ধার করে৷ এ সময় কাউন্সিলর বিভিন্ন মাধ্যমে আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন৷ কিন্তু আমি কথা বলিনি৷ পরে আমরা গাড়িতে ওঠার সময় কাউন্সিলরের লোকজন হামলা করে৷
তবে হামলার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম৷ তিনি বলেন, তাদের কালির ছড়াখাল যাওয়ার কথা৷ কিন্তু তাদের সঙ্গে থাকা মানুষজন ভুল বুঝিয়ে আমার খামারের কাছে নিয়ে আসে৷ তারা তাদের কাজ করে চলে গেছেন৷ হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি৷ ঘটনার সময় আমি খামারের অফিসে বসে ছিলাম৷
সেখানে ১৬টি সিসিটিভি রয়েছে৷ সেগুলোর ফুটেজ দেখলে বোঝা যাবে৷ আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা সঠিক নয়৷ আমিও এই ঘটনার তদন্ত দাবি করছি৷
ঘটনার বিষয়ে আকবর শাহ থানার ওসি ওয়ালিউদ্দিন আকবর বলেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান থানায় যে এজাহার জমা দিয়েছেন সেটা আমরা মামলা হিসেবে গ্রহণ করেছি৷ সেখানে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ পরিচয় না থাকায় গ্রেপ্তার প্রক্রিয়ায় যেতে পারিনি৷ এখন তদন্ত চলছে, দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷
এসডব্লিউএসএস/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ