আমাদের সিজনাল প্রতিবাদী সংস্কৃতি ক্ষমতার গদি জেঁকে বসাদের মুখ থেকে লাগামকে নিয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ক্ষমতাসীনরা জানে, অন্যায় অপরাধ যাই হোক; এক মাস পার না হতেই সব প্রতিবাদ স্বাভাবিক হয়ে যাবে, সব স্লোগান থেমে যাবে, সব পোস্টারের জায়গা হবে ডাস্টবিনে, সব সুসন্তান সুবোধ ছেলের মতো বাড়ি ফিরবে। তাই স্বভাবতই কোনও প্রতিবাদই তাদের টলাতে পারে না। মূলত কোন প্রতিবাদই তাদের কানে পৌঁছায় না। তারা গদিতে চেপে বসে, সবকিছু স্বাভাবিক হবার জন্য অপেক্ষা করে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে। মৃতদের জন্য শোক জানায় এবং জীবিতদের জন্য কবর খোঁড়ে।
কারণ সব অন্যায়, অপরাধ আর জুলুমের পর বাঙালির ভরপেট খেয়ে বিছানায় গড়িয়ে দেয়া ভুঁড়িটার নিচে চাপা পড়ে যায় সব স্লোগান, জমায়েত আর ব্যানার-ফেস্টুন। এ এক ঐতিহাসি সত্য। সবকিছু এখানে চিত্রনাট্য মেনেই হয় প্রতিবার। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কুমিল্লায় হামলা দিয়ে শুরু, আগুন ছড়ালো চাঁদপুর, এরপর পুড়লো রংপুরও। তারপর সবার গর্জে ওঠা। হাতে হাত মিলিয়ে অপশক্তি রুখে দেয়ার এক অদম্য ইচ্ছা সবার চোখে। তবে তার স্থায়ীত্ব কয়েকদিন। কোন পরিবর্তন তার লক্ষ্য নয়। যেন এক দারুণ দৃশ্যের মঞ্চায়ন। নাসিরনগর থেকে শুরু করে কুমিল্লা, প্রতিবাদ আমাদের কাছে সিজনাল উৎসব হয়ে উঠেছে। আমরা ১৫০ টাকা কেজি দিয়ে টমেটো কিনছি, বাসে চড়ছি। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করছি।
আমরা প্রতিবাদও করি নিয়ম মেনে। করতে হয়। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকমনাদের পাশাপাশি সমাজের নানা স্তরের মানুষ প্রতিবাদ করছে। কোন পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে নয়। করতে হয়, তাই করছে। না করলে, পাশের লোকটা মন্দ বলবে। না করলে, প্রগতিশীল বলে নিজেকে চালানো যাবে না। না করলে, প্রতিবাদের মঞ্চে চায়ের দোকানে আড্ডাটা মিস হয়ে যাবে। না করলে, কনসার্টে মাথা দোলানোর সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় গলাবাজির সুযোগ নষ্ট হবে। দেশ উদ্ধার করা হবে না।
আমরা সবাই প্রতিবাদী। শুধু পরিবর্তনবাদী নই। আমাদের প্রতিবাদের একটা চরিত্র দাঁড়িয়ে গেছে। যেমন আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার, আওয়ামী লীগের, বামদলগুলোর; তেমন আমাদের প্রতিবাদেরও আছে। ঋত্বিকের মতো আমরা গড়া চড়িয়ে বলি, পৃথিবীতে অ্যাপলিটিক্যাল কিংবা অরাজনৈতিক বলতে কিছুই নেই। এটা বলতে আমরা ভালোবাসি। রক্তে একটা উত্তাপ অনুভব করি। নিজেদের প্রগতিশীল লাগে। পিঠ চাপড়ে দেয় লোকে। মুক্তমনা বলে। গলায় কাঠের মালা ঝুলিয়ে, প্রেমিক বা প্রেমিকার হাত ধরে আমরা নবারুণ বা ঋত্বিকে কথা বলি। আমরা বাম করি, ডানদিকে কাঁত হয়ে থাকি। আমরা শাহবাগী।
আমরা মানববন্ধন করি, স্লোগান দিই। গান গাই, হাঁপিয়ে উঠি, চা খাই। কপাল ভালো থাকলে বিরিয়ানিও জোটে। এরপর আবার বিক্ষোভ করি, সমাবেশ করি, রাত জেগে ব্যানার লিখি। রোদে পুড়ি, মিছিল করি, মশাল জ্বালাই, মুখে আড়াই ইঞ্চির অ্যাপলিটিক্যাল হাসি ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরি। তবে এই সবকিছুই কয়েক সপ্তাহের জন্য। বড়জোর এক মাস। ঢাকায় আসার আগে কয়েক বছর রংপুরে ছিলাম। সেখানেও আন্দোলনের এই একই চরিত্র। প্রেসক্লাবে জড়ো হওয়া, মানববন্ধন, ভাষণ যা কিনা প্রতিপাদ্য বিষয়ের থেকে নাম ধাম আর পদবীর ভারে বিভ্রান্ত। ঢাকা রংপুর নয় গোটা দেশই এই চরিত্রে চরিত্রহীন।
সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে আমাদের ধর্ম টলে যায়, আমরা অসাম্প্রদায়িক। পূজায় ঘুরি, ঈদে দাওয়াত দিই। আমাদের মধ্যে ধর্মের বাড়াবাড়ি নেই। শুধু বাড়িভাড়াটা হিন্দুদের দিই না। শুধু প্রতিমার পেছনে গোঁজা কাঠামো নিয়ে হাসাহাসি করি। ইসলাম কতোটা উগ্র, তা নিয়ে আলোচনা করি।
এই সংস্কৃতি আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিকর না। গোবেচারার মতো দেখতে লাগে। তরুণ সমাজ একত্রিত হচ্ছে, হৈচৈ করছে, দেশ উদ্ধার করছে- এতে ক্ষতিটা কি! খুশির ব্যাপার। তারা খুশিও থাকে। নিজেদের বাম মনস্ক বলে। প্রগতিশীল ভাবে। তবে যখন প্রসঙ্গটা বারবার উঠে আসে প্রতি ঘটনার প্রেক্ষিতে, যখন প্রতিবাদটা হুইলচেয়ারে বসে পড়ে তখন ক্ষতির প্রশ্নটা উঠে দাঁড়ায়।
কুরআন অবমাননার অজুহাতে গোটা দেশে হিন্দুদের উপর নির্যাতন চালানো হল, ক্ষমতাসীন দল দুইতিনজনকে গ্রেফতার করল, পাঁচজন মারা পড়ল, এরপর সব শান্ত। আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলাম। খাচ্ছি দাচ্ছি সরকারকে গালি দিচ্ছি। অথচ রাষ্ট্রের শোষণের পথ প্রশস্ত যে আমরাই করে দিচ্ছি, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। আমরা ভাবছি না, কেন বারবার প্রতিবাদেও টলছে না দুঃশাসনের সিংহাসন। ভাবছি না ওই সিংহাসনের চার পা আমরা কাঁধে নিয়ে ঘুরছি। ভাবছি না, অপশক্তির গোড়ায় রোজ পানি ঢালছি আমরাই।
বারবার স্থান কেন্দ্রিক হচ্ছে আমাদের আন্দোলন। শাহবাগে মানুষ আসছে, প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়াচ্ছে- তবে শুধু শাহবাগেই। ঢাকার অন্য কোথায় আন্দোলন হচ্ছে? ঢাকা কি শুধু শাহবাগ? শাহবাগ কি গোটা দেশ? সারা দেশে আন্দোলন কখনওই ছড়িয়ে পড়ছে না। হয়তো কয়েকটি বিভাগীয় শহরে প্রতিবাদ হচ্ছে। কিন্তু জনমানুষের প্রতিবাদে কোন আন্দোলনই রূপ নিচ্ছে না। ফলে ব্যর্থ হচ্ছে।
এই ব্যর্থতা আমাদের অভ্যাস হয়ে উঠেছে। আর ক্ষমতাসীন সরকার এর সুযোগ নিচ্ছে ভালোভাবেই। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বাস ভাড়া বাড়ানো- নিজের সিদ্ধান্ত মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে সরকার একপ্রকার বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কারণ তারা জানে আমরা নখদন্তহীন বাঘ। আমরা সমস্যা গিলে ফেলতে শিখে গেছি বা আমাদের শেখানো হয়েছে। আমরা শোসনে নিরাপদ বোধ করি, ঘুরে দাঁড়ালেই মনে করি দেয়াল বাঁধবে। আমাদের শেখানো হয়েছে আমাদের বিকল্প নেই। আমাদের ভরসা ওই একটি দলই। আমাদের নিরাপত্তা, ভাতের থালা, পরনের কাপড়, মাসের বেতন তাদের দয়ার উপর চলছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার উপর আমাদের নির্ভরতা, গোটা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার প্রথম অন্তরায়। আমরা বেশি দামে বাজার করে, বাসে অতিরিক্ত ভাড়া গুনে, বাড়িতে ফিরে ফেসবুকে গালি দিচ্ছি। প্রতিবাদ করছি। কমেন্টে মুক্তিযুদ্ধ করছি। লাইক শেয়ারে খুশি হয়ে ঘুমাতে যাচ্ছি। সেলিব্রিটি হচ্ছি। বই লিখছি সমস্যা নিয়ে। প্রতিকার না পেলে চা খাচ্ছি।
তবু ধর্মঘটে অফিসে যেতেই হবে আমাদের। ৮০ টাকার ভাড়া ৮০০ টাকা দিয়ে আমরা গাড়িতে চড়ছি। ঘামছি, নাকাল হচ্ছি, গালি দিচ্ছি ড্রাইভারকে। কন্ডাকটরের কলার চেপে ধরছি। কিন্তু অফিস ঠিকই করছি। অথচ ধর্মঘট তো আমরাও করতে পারি। সাধারণ মানুষ। অফিস আদালতে না গিয়ে। সব ধরনের সরকারি কর্মকাণ্ড স্থগিত করে। কিন্তু না, আমরা হ্যাশট্যাগ দেব। ওটা সহজ। ওটা নিরাপদ।
আমরা প্রতিবাদ করি সরকারের হয়ে, আমরা রাস্তায় দাঁড়াই ক্ষমতার পক্ষে। শোষিত নির্যাতিতরা এখানে কেবলই আমাদের গণতান্ত্রিক হয়ে উঠার উপায় মাত্র। ধুঁকতে থাকা গণতন্ত্র যে এখনও টিকে আছে এটা আমরা প্রচার করি। আমরা রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ দাস। কোন প্রতিবাদ কতটা করতে হবে, আমাদের বলা হয়, আমরা আদেশ পালন করি। আমরা দেশ উদ্ধার করি। আমাদের পিঠে ফুটে থাকা চাবুকের দাগ নিয়ে কথা বলি, গল্প করি, চা খাই। সরকার পরিবর্তনের হিসাবনিকাশ করি। এরপর ভোটের সমুদ্র পার হই নুহের নৌকায় চড়ে। আমাদের বিকল্প নেই। আমরা প্রতিবাদ করি। আমরা জেল খাটি। চিত্রনাট্যের সফল মঞ্চায়ন শেষে আমরা বাড়ি ফিরি। ভাত খাই। প্রেম করি। আর্ট কালচার করি। দেশ উদ্ধার করি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮২৫
আপনার মতামত জানানঃ