বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির প্রভাব ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ফলশ্রুতিতে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ভারতে বেকার হয়ে পড়েছে লাখ লাখ যুবক। সেই বেকারদের একাংশ হতাশ হয়ে বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ। বেকারত্ব ছাড়াও নানা কারণেই ভারতে বাড়ছে আত্মহত্যা। উদ্বেগের বিষয় হলো দিন দিন এর সংখ্যা বাড়ছেই।
আত্মহত্যা নিয়ে ভারতের ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত দশ মাসে ভারতে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৫২ জন আত্মহত্যা করেছেন। যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি। আর আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশই দিনমজুর।
আত্মহত্যার মোট সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্র। রাজ্যটিতে গত দশ মাসে আত্মহত্যা করেছেন ১৯ হাজার ৯০৯ জন।
অন্যদিকে চতুর্থ স্থানে থাকা পশ্চিমবঙ্গে গত দশ মাসে আত্মহত্যা করেছেন ১৩ হাজার ১০৩ জন। যা ভারতের মোট আত্মহত্যার ৮ দশমিক ৬ শতাংশ।
আত্মহত্যার মূল কারণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পারবারিক কলহের কারণে ৩৩ দশমিক ৬ শতাংশ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ১৮ শতাংশ মানুষ শারীরিক অসুস্থতা সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। তেমনই বিয়ে ও প্রেমজনিত কারণে আত্মহত্যা করেছেন যথাক্রমে ৫ ও ৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ। পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী।
জীবিকার দিক থেকে দেখলে গত ১০ মাসে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন দিন মজুরেরা। তাদের আত্মহত্যার হার ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে মানসিক অবসাদে ভুগে আত্মহত্যার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন গৃহবধুরা, হার ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যারা আত্মহত্যা করছেন, তাদের মধ্যে অবিবাহিত পুরুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। চলতি বছরে প্রায় ২৫ হাজার অবিবাহিত মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। বিপরীতে অবিবাহিত নারীদের আত্মহত্যার সংখ্যা ১১ হাজারের কাছাকাছি।
পুরুষদের মধ্যে ১৮-৩০ বছর এবং ৩০-৪৫ বছরের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা প্রায় সমান। দু’টি বয়সের বিভাগে আত্মহত্যা করেছেন যথাক্রমে ৩৪ হাজার ৬২৯ জন ও ৩৬ হাজার ৫২৫ জন। সেখানে ১৮-৩০ বছরের তরুণী ও নারীরা চলতি বছর সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আত্মহত্যা করেছেন। সংখ্যাটি হলো ১৮ হাজার ৭৩।
এছাড়া মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি, হার ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ। আর যারা এমবিএ-র মতো প্রফেশনাল কোর্স করেছেন, তাদের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে কম, হার মাত্র ০.৩ শতাংশ।
জীবিকার দিক থেকে দেখলে গত ১০ মাসে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন দিন মজুরেরা। তাদের আত্মহত্যার হার ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে মানসিক অবসাদে ভুগে আত্মহত্যার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন গৃহবধুরা, হার ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
এর আগে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র (এনসিআরবি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ভারতে বেকারত্বের কারণে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ২৪ শতাংশ।
এনসিআরবির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বেকারত্বের কারণে ভারতে আত্মহত্যা করেন ২ হাজার ২৯৮ জন। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৮৫১ জনে। মধ্যবর্তী সময়ে ২০১৭ সালে ২ হাজার ৪০৪ ও ২০১৮ সালে ২ হাজার ৭৪১ জন বেকার আত্মঘাতী হন।
করোনা প্রাদুর্ভাবের আগেই ভারতে বেকারত্বের হার পৌঁছে যায় ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে। অতিমারির কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে বলেই আশঙ্কা। গত বছর এনসিআরবি জানিয়েছিল, এক দশকে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন দিনমজুররা।
গত বছর মার্চে করোনার হানার পর থেকেই ভারতে কাজের বাজার বিপর্যস্ত। দীর্ঘ লকডাউনের ধাক্কায় ২০২০ সালের এপ্রিল ও মে মাসে বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এরপর লকডাউন শিথিল হওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা ধীরে ধীরে নামতে থাকে।
কিন্তু মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে সে পরিস্থিতি বদলে যায়। সংক্রমণ রোধ করতে রাজ্যগুলো স্থানীয় লকডাউন এবং বিধিনিষেধের পথে হাঁটায় আবারও বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পায়। বাড়তে বাড়তে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভারতে বেকারত্বের হার দুই অঙ্ক পেরিয়ে যায়। বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় তা আবারও কমতে থাকে। সংশ্লিষ্ট মহলের ব্যাখ্যা, আর্থিক কর্মকাণ্ডে গতি আসা এবং বর্ষা মৌসুমের ওপর নির্ভর করেই বদলে যায় কাজের বাজারের অবস্থা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতির গতি কমে যাওয়ায় গত বছর লকডাউনের আগে থেকেই বেকারত্ব বাড়ছিল। ফলে করোনা মোকাবিলায় পুরো দেশ ঘরবন্দি হতেই বেকারত্বের হার অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে আর্থিক কর্মকাণ্ড শুরু হলে বেকারত্বের হার কমতে শুরু করে বটে, কিন্তু কর্মসংস্থানের গতি প্রত্যাশার তুলনায় অনেক পিছিয়েই ছিল। কাজকর্ম শুরু হলেও নিয়োগে ধারাবাহিক উন্নতি তেমন একটা চোখে পড়েনি।
মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা না দিলে এবং প্রতিষেধক প্রয়োগের সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে তাকে শুরুতেই শক্ত হাতে থামানো গেলে ভয় কাটত বলে মনে করছেন ভারতের সংশ্লিষ্ট মহল। তাদের মতে, উৎপাদন এবং পরিষেবা বৃদ্ধির হাত ধরে অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানো নিশ্চিত হলে নিয়োগও বাড়ত। কিন্তু সিএমআইই তথ্য বলছে, এপ্রিলে তা তো হয়নি, বরং কর্মী আরও কমেছে। এমনকি কাজ খুঁজতেও বেরিয়েছেন অনেক কম মানুষ।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আত্মহত্যার এই ঘটনা ভারতে মানুষের বেঁচে থাকার গভীর অনিচ্ছার ছবি ফুটিয়ে তুলেছে।
তাদের মতে, ‘এটা বেশিরভাগ ভারতীয়দের জন্য বড় ধাক্কা। সমৃদ্ধ পশ্চিমাঞ্চলে মুম্বাইয়ের মতো বড় শহর ও বন্দর রয়েছে। পাশেই রয়েছে ভারতের বাণিজ্য কেন্দ্র গুজরাট রাজ্য। সেখানে বড় বড় প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি রুপি বিনিয়োগ করা হয়। প্রতিদিন কাজের সন্ধানে বিভিন্ন রাজ্য থেকে হাজার হাজার মানুষ সেখানে চলে যায়। তারপরও যদি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, তাহলে বুঝতে হবে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা আসলেই অনেক ভয়াবহ।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০১
আপনার মতামত জানানঃ