বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার প্রবণতা কমছে। সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি নানা উদ্যোগের কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা নিম্নমুখী। জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেটের এক নিবন্ধে এমন চিত্র উঠে এসেছে। ওই নিবন্ধে বাংলাদেশেও আত্মহত্যার প্রবণতা কমে আসার কথা বলা হয়েছে। তবে স্থানীয় জরিপ অনুযায়ী, কিছুটা কমলেও বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার এখনো তুলনামূলক অনেক বেশি। ২০২৩ সালে দেশে প্রতিদিন গড়ে ৫৬ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন।
১৯৯০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিশ্বে আত্মহত্যার প্রবণতা বিশ্লেষণ করে গত মাসের শেষ সপ্তাহে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে ল্যানসেট। এতে বাংলাদেশের আত্মহত্যা–সম্পর্কিত পরিসংখ্যানও প্রকাশ করে বলা হয়েছে, প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে তিনজনের বেশি আত্মহত্যা করছেন। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অর্থায়নে পরিচালিত জরিপ বলছে, দেশে ১ লাখ মানুষে ১২ জন আত্মহত্যা করছেন।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, বৈশ্বিক গবেষণার ক্ষেত্রে ল্যানসেট সাধারণত অনুমিত সংখ্যা ব্যবহার করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তারা অনুমিত সংখ্যা ব্যবহার করেছে। জরিপের তথ্য না থাকলে অনুমিত সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে যেহেতু জরিপ হয়েছে, সুতরাং জরিপের তথ্যই নির্ভরযোগ্য।
ল্যানসেটে প্রকাশিত নিবন্ধের শুরুতে বলা হয়েছে, আত্মহত্যাকে বিশ্বব্যাপী জরুরি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যা প্রতিরোধে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আত্মহত্যার পেছনে সামাজিক, পরিবেশগত ও জিনগত কারণ কাজ করে। মানসিক সমস্যা আছে—এমন মানুষের আত্মহত্যার ঝুঁকি বেশি। ব্যক্তির মাধ্যমে সহিংসতার শিকার, নিজের কাছের মানুষের দ্বারা সহিংসতার শিকার, যৌন সহিংসতার শিকার বা হয়রানি বা শৈশবের কোনো তীব্র মানসিক আঘাতের কারণে মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে।
এখনকার দিনে মানুষ নানা কারণে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। নিঃসঙ্গতাও মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আগ্নেয়াস্ত্র বা কীটনাশকের মতো জিনিস সহজলভ্য হওয়াটা আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়িয়েছে। দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্যের সঙ্গেও আত্মহত্যার সম্পর্ক আছে। এসব বিষয় এক হয়ে আত্মহত্যা একটি বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
গবেষকেরা ২০৪টি দেশের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা ১৯৯০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়কে বেছে নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন যে পদ্ধতির মাধ্যমে বৈশ্বিক রোগের বোঝা পরিমাপ করে আসছে, আত্মহত্যা পরিমাপের ক্ষেত্রেও সেই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।
বৈশ্বিকভাবে ১৯৯০ সালে প্রতি লাখ মানুষের মধ্যে ১৪ দশমিক ৯ জন আত্মহত্যা করতেন। ২০২১ সালে দেখা গেছে, এক লাখ মানুষের মধ্যে আত্মহত্যা করছেন নয়জন।
ভৌগোলিকভাবে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি পূর্ব উইরোপের দেশগুলোয়। প্রতি লাখ মানুষে ১৯ দশমিক ২ জন আত্মহত্যা করে থাকেন। ১৯৯০ সালে ৪৩ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি ছিল। ২০২১ সালে দেখা গেছে, আত্মহত্যার প্রবণতা ৪৭ বছর বয়সীদের মধ্যে বেশি। নারীদের ক্ষেত্রেও বয়সের এই পরিবর্তন দেখা গেছে। ১৯৯০ সালে ৪২ বছর বয়সী নারীরা বেশি ঝুঁকিতে ছিলেন, ২০২১ সালে এসে সেই ঝুঁকি দাঁড়ায় ৪৭ বছর বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে।
ল্যানসেটের গবেষণায় বলছে, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে এক লাখ মানুষের মধ্যে ৮ দশমিক ১ জন আত্মহত্যার করতেন। তা কমে ২০২১ সালে ৩ দশমিক ৬৬ জনে দাঁড়ায়। ওই হিসাব বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে ৬ হাজার ৫০ জন আত্মহত্যা করেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আর্থিক সহায়তায় জাতীয় জরিপ (২০২২–২৩) করেছে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)। ২০১৬ সালেও তারা জরিপ করেছিল।
জরিপ বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ২০ হাজার ৫০৫ জন আত্মহত্যা করেন। প্রতিদিন গড়ে ৫৬ জন দেশের কোথাও না কোথাও আত্মহত্যা করেছেন। প্রতি লাখে আত্মহত্যা করেছেন ১২ দশমিক ৪ জন। ২০১৬ সালে আত্মহত্যা করেছিলেন ২৩ হাজার ৮৬৮ জন; প্রতি লাখে ১৪ দশমিক ৭ জন।
সর্বশেষ জরিপ বলছে, দুর্ঘটনার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার পর দৈনিক সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান আত্মহত্যায়। ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী নারীদের এবং ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী পুরুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। শহরের চেয়ে গ্রামে আত্মহত্যার হার বেশি। আত্মহত্যা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে বেকারদের মধ্যে। গলায় ফাঁস ও কীটনাশক পান—আত্মহত্যার জন্য মানুষ এই দুটি পথই বেশি বেছে নিচ্ছেন।
সিআইপিআরবির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক এ কে এম ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে হয়তো আত্মহত্যার প্রবণতা কমেছে। কমলেও তা খুবই সামান্য। এখনো বহু মানুষ আত্মহত্যা করছেন। ল্যানসেটে প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে তা কয়েক গুণ বেশি।’
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে আত্মহত্যার ধরন ও প্রবণতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। বিশেষ এলাকা বা বয়স যদি ঝুঁকিপূর্ণ হয়, তাহলে সে ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষিকাজে ব্যবহৃত কীটনাশক বাজারজাত ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ