অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে কক্সবাজারের ৩৪ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প। খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক কিংবা মানব পাচার শরণার্থী ক্যাম্পের নিত্য ঘটনা। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং নিজেদের অবস্থান সংহত করতে প্রায়ই অস্ত্রের মহড়া কিংবা রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা। মাঝেমধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানের মুখে কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও থামানো যাচ্ছে না শরণার্থী ক্যাম্পের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর অপরাধ তৎপরতা।
গত চার বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে ১ হাজার ২৯৮টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি হয়েছে ২ হাজার ৮৫০ রোহিঙ্গা। ক্যাম্পগুলোর ভেতরে ১৫ থেকে ২০টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে মাদক ব্যবসাসহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড। অভিযোগ উঠেছে, এখানে প্রতিদিন প্রায় শতকোটি টাকার ইয়াবার লেনদেন হয়। শুধু তাই নয়, দেশের সব ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নাকি এসব ক্যাম্প থেকেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ৭৬টি; আসামি ছিল ১৫৯ রোহিঙ্গা। অথচ চলতি বছর মাত্র ছয় মাসেই ৫৬৭টি মামলায় রোহিঙ্গা আসামির সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
বিভিন্ন অপরাধজনিত কারণে বর্তমানে কক্সবাজার কারাগারে রয়েছে চার শতাধিক রোহিঙ্গা। মাদক পাচারের মতো অপরাধে জড়িয়ে এদের অনেকে বিপুল অর্থসম্পদের মালিকও হয়েছে।
স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা।
স্থানীয় জনগণ তো বটেই, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পর্যন্ত স্বীকার করা হচ্ছে যে রোহিঙ্গারা পরিবেশ নষ্ট করছে, নারী ও শিশু পাচার, মাদক পাচারসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজে যুক্ত হচ্ছে, এমনকি তারা বাংলাদেশের জন্য একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও চার বছর আগের বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত, তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের বক্তব্য অস্বাভাবিক নয়। মূলত অতীতে রোহিঙ্গাবিষয়ক সিদ্ধান্ত, দূরদর্শিতার বদলে নীতিনির্ধারকদের একপেশে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দিয়ে কতটুকু প্রভাবিত হয়েছিল, সে প্রশ্ন চলে আসে। এ প্রশ্নের উত্তরই বলে দেবে, কেন আজ রোহিঙ্গাদের বোঝা মনে হচ্ছে।
ক্যাম্পগুলোর ভেতরে ১৫ থেকে ২০টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে মাদক ব্যবসাসহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড। অভিযোগ উঠেছে, এখানে প্রতিদিন প্রায় শতকোটি টাকার ইয়াবার লেনদেন হয়। শুধু তাই নয়, দেশের সব ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নাকি এসব ক্যাম্প থেকেই।
সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা ও আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হওয়ার পর ক্যাম্পকেন্দ্রিক অপরাধ নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
একসময়ের শিক্ষক মুহিবুল্লাহ সামরিক বাহিনী-সমর্থিত রাজনৈতিক দল ইউএসডিপির (ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের চেয়ারম্যান বা সভাপতি ছিলেন। সামরিক পৃষ্ঠপোষক দলের স্থানীয় নেতা হওয়ার সুবাদে একদিকে যেমন তার কর্মী-সমর্থক ছিল, অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিরোধিতাও ছিল। একই সঙ্গে রাখাইনের কথিত সরকারবিরোধী সশস্ত্র দল, যেমন ওই সময়কার আরাকান আর্মি (এএ) এবং কথিত ‘আরসা’ তার শত্রু হয়ে উঠেছিল। কাজেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হঠাৎ তার নেতৃত্ব গড়ে ওঠা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেই তার সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’(এআরএসপিএইচ) গঠন করেন এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
২০১৯ সালে কুতুপালং ক্যাম্পে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর জমায়েত করে বাংলাদেশ সরকারকে একদিকে যেমন বিবৃত করে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তিমত্তা দেখায়। এরপর মুহিবুল্লাহর উত্থান লক্ষণীয়। ওই বছর মুহিবুল্লাহ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বক্তব্য দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ওভাল অফিসে দেখা করে আন্তর্জাতিক আলোচনায় আসেন। অবশ্য মুহিবুল্লাহকে নিয়ে সরকারের মধ্যে অস্বস্তিও ছিল।
যদিও বর্তমানে কয়েকজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তবে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিষয়ে তেমন কোনো বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে তার ঘনিষ্ঠজনদের তরফ থেকে বলা হয়েছে, তিনি ‘আরসা’র আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
বিষয়টি এত সহজ মনে হয় না। মিয়ানমার গোয়েন্দা সূত্র এবং কিছু কিছু আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, পুরোনো সংগঠন আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন) একসময় বাংলাদেশ সীমান্তে তৎপর ছিল এবং তারা নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও ওই গ্রুপের কর্মকাণ্ড রয়েছে, যাদের সঙ্গে মুহিবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। একই সঙ্গে মহিবুল্লাহ এনইউজির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও কর্মীদের দাবি, অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরেই অন্তত ১৫ থেকে ২০টি সক্রিয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। এর বাইরে ক্যাম্পকেন্দ্রিক রয়েছে আরও একাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। প্রত্যেক বাহিনীতে ৩০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে ক্যাম্পগুলো হয়ে ওঠে অপরাধের অভয়ারণ্য। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি ও খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পগুলোতে দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকলেও রাতে তা অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সদ্য কারামুক্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক কয়েকজন শীর্ষ মাদক কারবারি বলেন, ক্যাম্পে প্রতিদিন শতকোটি টাকার বেশি ইয়াবার লেনদেন হয়ে থাকে। অন্তত ৩০ থেকে ৪০ লাখ ইয়াবা প্রতিদিন হাতবদল হচ্ছে। তারা আরও বলেন, মূলত ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে-বাইরে অন্তত অর্ধশতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে।
ক্যাম্পে অধিক পরিচিত সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে রয়েছে মাস্টার মুন্না গ্রুপ, মৌলভী ইউসুফ গ্রুপ, রকি বাহিনী, শুক্কুর বাহিনী, আব্দুল হাকিম বাহিনী, সাদ্দাম গ্রুপ, জাকির বাহিনী, নবী হোসেন বাহিনী, পুতিয়া গ্রুপ, সালমান শাহ গ্রুপ, গিয়াস বাহিনী, শাহ আজম গ্রুপ ইত্যাদি।
অভিযোগ আছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিক্তিক বেশিরভাগ সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিদের যোগাযোগ রয়েছে। ক্যাম্প অশান্ত করার জন্য সন্ত্রাসী গ্রুপকে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা ফ্রিতে দিচ্ছে মিয়ানমার সরকার। মূলত বিশ্বের দরবারে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরা, আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়াকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করা এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত করতে চায় মিয়ানমার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সামনে ‘রোহিঙ্গা’ বিষয় একটি বড় ধরনের জটিল চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে, যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমাধান সম্ভব নয়। কূটনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা নেতৃত্বের বিকাশ ঘটিয়ে বিকল্প পথের সরকারের সব আন্তরিক প্রচেষ্টা সহজে কার্যকর হচ্ছে না। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের উদার গণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকার রক্ষাকারী চ্যাম্পিয়নদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
তারা বলেন, বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় চোরাচালান রুট ও অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে খ্যাত উখিয়া-টেকনাফে খোদ এ দেশীয় চোরাচালানি ও অপরাধীদের বিচরণ ও কার্যক্রম যখন প্রকাশ্যে ঘটমান, তখন কিছু রোহিঙ্গা সেখানে ব্যবহৃত হবে বা নিজ উদ্যোগে সেসব ঘটনার অংশীদার হবে, এমনটা বিচিত্র নয় মোটেও। দুঃখজনক হলেও সত্য যে মানবিকতার পাশাপাশি দূরদর্শিতা নিয়ে এমন কোনো নীতি রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশে গ্রহণ করা হয়নি, যা বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের হত্যার বিচার করতে এবং মিয়ানমারকে নিজ দেশের মানুষকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করতে পারত। পেঁয়াজ থেকে আইস—বৈধ বা অবৈধ সব পথেই বাণিজ্য অব্যাহত রেখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন। বাংলাদেশ দুর্বল নয়, কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে উদারতা ও মানবিকতা দেখানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের দূরদর্শী সবল দিকটি বোধ করি প্রকাশ করার সময় হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৩
আপনার মতামত জানানঃ