পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ইসলামি গোষ্ঠী তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তানের (টিএলপি) সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বুধবার ব্লাসফেমি-বিরোধী বিক্ষোভে দেশটির পাঞ্জাব প্রদেশের গুজরানওয়ালা জেলায় সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটে। এতে কমপক্ষে চার পুলিশ নিহত ও ২৬৩ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য ডন এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
পাঞ্জাব পুলিশের এক মুখপাত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, টিএলপির কর্মী-সমর্থকেরা এসএমজি, একে-৪৭ ও পিস্তল নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালান। এতে পুলিশের বেশ কিছু সদস্য হতাহত হন।
কাতারভিত্তিক আল–জাজিরা টেলিভিশনের অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রাশিদ আহমেদ গতকাল সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় পাঞ্জাবে আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেন। সাংবাদিকদের তিনি জানান, আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পাঞ্জাবে ৬০ দিন থাকবেন। পাঞ্জাবের যেকোনো জায়গায় অভিযান চালানোর এখতিয়ার তাদের দেওয়া হয়েছে।
টিএলপির কর্মী-সমর্থকদের রাজধানী ইসলামাবাদে আসা ঠেকাতে সরকার শক্তি প্রয়োগ করবে বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী। তিনি জানান, সরকার টিএলপিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে দেখবে না। তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দেখা হবে। টিএলপিকে ইতিমধ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এদিকে পাকিস্তানে নিষিদ্ধঘোষিত উগ্র ডানপন্থি দল তেহরিক-ই-লাব্বাইকের (টিএলপি) বিক্ষোভ দমনে মাঠে নামানো হচ্ছে সুপ্রশিক্ষিত রেঞ্জার্স সদস্যদের। বুধবার (২৭ অক্টোবর) সন্ধ্যায় পাকিস্তানি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ ঘোষণা দিয়েছেন, পরবর্তী ৬০ দিন পাঞ্জাবে বিপুল সংখ্যক রেঞ্জার্স মোতায়েন থাকবে। তার এই ঘোষণায় স্পষ্ট যে, উদ্ভূত পরিস্থিতি পুলিশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ফলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পাকিস্তানে।
গত শুক্রবার (২২ অক্টোবর) টিএলপির কয়েক হাজার কর্মী ইসলামাবাদের দিকে লং মার্চ শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। সেদিন দুই পুলিশ সদস্য প্রাণ হারান। বুধবারও পুলিশ-টিএলপির মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। এতে তিন পুলিশ সদস্য নিহত ও কয়েক ডজন আহত হয়েছেন।
এর পরপরই মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডাকেন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। শোনা যায় সেখানে তিনি বলেছেন, টিএলপি’কে কোনোভাবেই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে দেওয়া হবে না। বৈঠক শেষে পাকিস্তানি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পাঞ্জাবে রেঞ্জার্স নামানোর ঘোষণা দেন।
ডনের খবর অনুসারে, রেঞ্জার্স সদস্যদের মাঠে নামানোর এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে অবশ্যই মন্ত্রিসভায় গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে থাকা অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা নিশ্চয় জানেন, হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োজনে লড়াইয়ের জন্য রেঞ্জার্স নামানো উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে আগুনে ঘি ঢালার সমতুল্য হতে পারে।
গত কয়েকদিনে পুলিশের সঙ্গে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হলেও এতে টিএলপির কেউ হতাহত হয়েছেন কিনা তা নিশ্চিত করা হয়নি। নিষিদ্ধঘোষিত দলটির সমর্থকেরা পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালা জেলায় ঘাঁটি গেড়েছে এবং তাদের নেতারা বারবার বলছেন, যত বাধাই আসুক, তারা ইসলামাবাদ অভিমুখে লং মার্চ চালিয়ে যাবেন।
এ অবস্থায় বিক্ষোভকারীদের সামনে সশস্ত্র রেঞ্জার্স সদস্যদের দাঁড় করিয়ে দেওয়ায় আতঙ্ক বিরাজ করছে পাকিস্তানজুড়ে। যেকোনো সময় পরিস্থিতি আরও সহিংস হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কিছুদিন আগে ফ্রান্সে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ পায়। এর পক্ষে কথা বলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন। তার প্রতিবাদে টিএলপি পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ফ্রান্সের দূতাবাস বন্ধ করে দেয়ার দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি তারা পাকিস্তান থেকে ফরাসি রাষ্ট্রদূতের বহিষ্কার দাবি জানিয়ে আসছে। তবে সরকার পরিষ্কারভাবে ঘোষণা দিয়েছে যে, পাকিস্তানে ফরাসি দূতাবাস বন্ধ করে দিতে টিএলপির দাবি তারা মানবে না। এ ছাড়া পাকিস্তানে নেই দেশটির রাষ্ট্রদূত।
মঙ্গলবার পাকিস্তানের বেসামরিক ও সামরিক নেতাদের মধ্যে বৈঠক হয়। এর পরদিনই বুধবার সরকার নিষিদ্ধ ঘোষিত টিএলপি-এর বিরুদ্ধে দমননীতি চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারা যাতে কোনো লং মার্চে অংশ নিতে না পারে, সে ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে পুলিশকে নির্দেশ দেয়। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপরিষদের এক মিটিংয়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পাঞ্জাবের আইন শৃংখলা রক্ষায় ৬০ দিন মাঠে থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে রেঞ্জারসদের।
বিক্ষোভকারীদের সামনে সশস্ত্র রেঞ্জার্স সদস্যদের দাঁড় করিয়ে দেওয়ায় আতঙ্ক বিরাজ করছে পাকিস্তানজুড়ে। যেকোনো সময় পরিস্থিতি আরও সহিংস হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মন্ত্রীপরিষদের মিটিংয়ের পর তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, টিএলপিকে একটি জঙ্গি সংগঠন হিসেবে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রীপরিষদ। অন্য যেসব গ্রুপকে নির্মূল করে দেয়া হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও একই রকম আচরণ করা হবে। আল কায়েদার মতো বড় জঙ্গি সংগঠনকেও পরাজিত করেছে পাকিস্তান। ফাওয়াদ চৌধুরী আরো বলেন, মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী একটি বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছেন। এতে উপস্থিত ছিলেন সামরিক, গোয়েন্দা বিষয়ক এজেন্সিগুলো এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নেতা ও প্রতিনিধিরা। তাতে সিদ্ধান্ত হয়েছে, টিএলপি’কে রাজনৈতিক দল হিসেবে আর দেখা হবে না। তাদেরকে দেখা হবে একটি জঙ্গি সংগঠন হিসেবে। তাদেরকে আর সহ্য করা হবে না।
মন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী আরো বলেন, টিএলপি’কে ভারতের কিছু গ্রুপ অর্থ সহায়তা দিচ্ছে এ বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ আছে সরকারের হাতে। ভারতের ওই গ্রুপগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পাকিস্তানকে অপমান করে যাচ্ছে। তাই তাদের ছড়িয়ে দেয়া ‘ফেক নিউজ’ বা ভুয়া খবরের বিরুদ্ধে পাকিস্তান টেলিকমিউনিকেশন অথরিটিকে ব্যবহার করে দমনপীড়ন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রীপরিষদ।
তিনি আরো বলেন, কিছু সাংবাদিকও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে টিএলপি’কে আর রিট করতে দেয়া হবে না। কারণ, তাদেরকে দেখা হবে একটি জঙ্গি সংগঠন হিসেবে। তাদেরকে ধর্মীয় দল হিসেবে দেখা হবে না।
তিনি বলেন, ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় টিএলপি। তখন থেকেই তারা রাস্তায় বিক্ষোভ সমাবেশ এবং অবরোধের মতো কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। কিন্তু রাষ্ট্রের সহ্য করার একটা সীমা আছে।
তিনি আরো বলেন, জনগণের অধিকার আছে তার মত প্রকাশের। তাই বলে তাদের কথা শোনা না হলে তাদেরকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে দেয়া হবে না।
সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ বলেছেন, করাচির মতো এই প্রদেশেও আমরা আইন শৃংখলা রক্ষার জন্য ৬০ দিনের জন্য রেঞ্জারস মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। টিএলপির বিরুদ্ধে সতর্কতা দিয়ে তিনি বলেন, তারা যে আচরণ দেখাচ্ছে, তাতে তাদেরকে বৈশ্বিক একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না কিছু। দেশে শান্তির প্রয়োজনীয়তার বিষয় উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান চাপে আছে। তিনি আরো বলেন, কিছু নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক শক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবরোধ চায়। কারণ, তাদের চোখ রয়েছে পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে।
বুধবার পাঞ্জাবের মুরিদকে এবং সাধুকে এলাকার কাছে পুলিশের সঙ্গে সহিংস সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে টিএলপি নেতারা। এতে কমপক্ষে চার পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। দাবি আদায়ের জন্য টিএলপি রাজধানী ইসলামাবাদমুখী লং মার্চ শুরু করার পর ভয়াবহ সংঘর্ষ সৃষ্টি হয় সেখানে। অন্যদিকে টিএলপি দাবি করেছে সংঘর্ষে তাদের দু’জন কর্মী নিহত হয়েছেন। সংগঠনটির মুখপাত্র বলেছেন, তাদের র্যালি ছিল শান্তিপূর্ণ। তাতে পুলিশ অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৫
আপনার মতামত জানানঃ