দ্বিতীয় ধাপে সারা দেশে ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় সবক’টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তবে এই মনোনয়ন নিয়ে দেখা দিয়েছে দুর্নীতি। যোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন না দিয়ে অপরাধী ও দুর্নীতিগ্রস্তদের মনোনয়ন দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
সে কারণে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা–কর্মী চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তারা স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও মূলত আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিপরীতে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর ভূমিকায় আছেন।
এর মধ্যে জামালপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এক স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীকে সমর্থন জানিয়ে আওয়ামী লীগের ৬০০ নেতা-কর্মী পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। কেন্দুয়া মুকুল নিকেতন স্কুল মাঠে গত বুধবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা আসে।
নেতা-কর্মীদের পক্ষে লিখিত বক্তব্য রাখেন কেন্দুয়া ইউনিয়নের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী সাইফুল ইসলাম খান। তিনি সদর উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক।
তিনি বলেন, ‘কেন্দুয়া ইউনিয়নে দুর্নীতিবাজ ও অনুপ্রবেশকারী শেখ মো. মাহবুবুর রহমান বারবার নৌকা প্রতীক পাচ্ছেন। এর প্রতিবাদে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের পদধারী ৬০০ নেতা-কর্মী পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
সাইফুল আরও বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে মাহবুবুরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন সময়ে তা গণমাধ্যমেও এসেছে। পরাজয়ের আশঙ্কায় ইতোমধ্যে আমার নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করেছে তার সমর্থকরা।’
প্রসঙ্গত, কেন্দুয়া ইউনিয়ন পরিষদের ভোট ১১ নভেম্বর। ৯ ওয়ার্ডে মোট ভোটার ২৯ হাজার ৯৫৭ জন।
এদিকে, সারাদেশে ৬৩ জেলায় আওয়ামী লীগের প্রচুর বিদ্রোহী প্রার্থী পাওয়া গেছে। গণমাধ্যমকর্মীরা ৮৪৮টি ইউপিতে ৮৯৭ জন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর সন্ধান পেয়েছেন। তারা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। তাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন সাংসদের স্বজনও আছেন। আবার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কমিটিতে থাকা নেতারাও অনেকে বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন করছেন।
প্রসঙ্গত, আগামী ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ১৭ অক্টোবর ছিল মনোয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল ২৬ অক্টোবর, প্রতীক বরাদ্দ ছিল ২৭ অক্টোবর।
বিদ্রোহীদের ছড়াছড়ি
যশোরের ঝিকরগাছায় ১১টি ইউপিতে নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে আটটি ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে যশোর-২ আসনের ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ নাসির উদ্দীনের ভাই ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম গিয়াস উদ্দীনও বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন মাগুরা ইউপি থেকে। এ ছাড়া চৌগাছায় ১১ ইউপিতে ১৯ বিদ্রোহী আছেন।
শেরপুর সদর উপজেলার ১৪টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত ১৪ প্রার্থীসহ ৫৯ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে ছয় ইউপিতে সাতজন বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে জাতীয় সংসদের হুইপ মো. আতিউর রহমানের বড় ভাই মো. ইসমাইল হোসেন বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। তিনি কামারিয়া ইউনিয়ন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ীর ১৬টি ইউপিতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে তানোরের ৭টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ৩৪ জন ও গোদাগাড়ীর ৯টি ইউনিয়নে ৩৮ জন চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। দুই উপজেলায় ২৪ জন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আছেন।
তানোরের কলমা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাইনুল ইসলাম নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ ওমর ফারুক চৌধুরীর চাচাতো ভাই ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খাদেকুন্নবী বাবু চৌধুরী।
পাবনার সুজানগর উপজেলার ১০টি ইউপিতে ৩৩ জন বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন। বিদ্রোহীদের মধ্যে সাতবাড়িয়া ইউনিয়নে পাবনা-২ (বেড়া-সুজানগর) আসনের সাংসদ আহম্মেদ ফিরোজ কবিরের ছোট ভাইও আছেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম শামসুল আলম সাতবাড়িয়ায় নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন পাবনা-২ (বেড়া-সুজানগর) আসনের সাংসদ আহম্মেদ ফিরোজ কবিরের ছোট আহমেদ ফেরদৌস কবির ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা আবুল হোসেন।
লালমনিরহাটের আদিতমারীর আটটি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে ছয়টি ইউপিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা তাদের মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। সারপুকুর ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য নীল কমল রায়। একই ইউপিতে আরেক বিদ্রোহী হচ্ছেন উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি বাদশা আলমগীর।
কুষ্টিয়ার মিরপুর ও ভেড়ামারায় ১৭টি ইউপিতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। দুই উপজেলায় ১৩ জন বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন। মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন শারমিন আক্তার। তার বিপরীতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আনোয়ারুরজ্জামান বিশ্বাস।
ভেড়ামারায় জুনিয়াদহ ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসানুজ্জামান, ধরমপুরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সামসুল হক ও চাঁদগ্রামে উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক মজিবুল হকও বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন।
মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের ১১ ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন ৪৬ জন। এর মধ্যে আটটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৩ জন নেতা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন।
এদিকে, চারটি জেলায় আওয়ামী লীগের কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী নেই। রাজবাড়ীতে দুটি, হবিগঞ্জে পাঁচটি, খাগড়াছড়িতে ১০টি ও রাঙামাটিতে ১১টি ইউপির একটিতেও আওয়ামী লীগের কোনো বিদ্রোহী পাওয়া যায়নি। আবার উল্টো চিত্র আছে বেশ কয়েকটি স্থানে। নওগাঁয় ২০টি ইউপির বিপরীতে সবচেয়ে বেশি— ৪২ জন বিদ্রোহী প্রার্থী পাওয়া গেছে। এর কারণ দলীয় মনোনয়ন নিয়ে অসন্তুষ্টি।
জেলায় বেশিসংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকার নজির আরও আছে। সিরাজগঞ্জের ১৭ ইউপিতে ৩৫ জন, পাবনার ১০ ইউপিতে ৩৩, নেত্রকোনার ২৬ ইউপিতে ৩৬, নরসিংদীর ১২ ইউপিতে ৩২ এবং সুনামগঞ্জের ১৯টি ইউপিতে আওয়ামী লীগের ৩৩ জন বিদ্রোহী প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
বিপাকে আওয়ামী লীগ
কারণ দর্শানোর নোটিশ, বহিষ্কার, ভবিষ্যতে দলীয় পদ-পদবী এবং মনোনয়ন না পাওয়া, দলের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে কোনো নোটিশ ছাড়াই দল থেকে বহিষ্কার, তৃণমূল থেকে সমঝোতার ভিত্তিতে কেন্দ্রে নাম পাঠানো— এতো সব উদ্যোগ নিয়েও বিদ্রোহী প্রার্থীদের দমন করতে পারছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে সবার মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা, কেন্দ্রে নাম পাঠানোর সময় স্বজন পোষণ, স্থানীয় রাজনীতিতে গ্রুপিং, বিরোধী দলগুলোর নির্বাচনের মাঠে না থাকা এবং দলের চেইন অব কমান্ডের অভাবের কারণেই বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে এবং এগুলোই বিদ্রোহী প্রার্থী না ঠেকাতে পারার কারণ বলে মনে করেন দলের নেতারা।
এবারও বরাবরের মতো দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৮৪৮ ইউপিতে প্রায় ৯০০ আওয়ামী লীগ নেতা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন।
দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা ও বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০১৬ সালে দলীয় গঠনতন্ত্র সংশোধন করে দলের প্রতীকের বিরুদ্ধে নির্বাচন করা দলীয় নেতাদের সরাসরি বহিষ্কারের ধারা অন্তর্ভুক্ত করে। তারপরেও, বিদ্রোহী প্রার্থী দমন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের জন্য আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনে অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী দলের মনোনীত প্রার্থীদের পরাজিত করেছেন। ২০ সেপ্টেম্বর ১৬০টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচন মহামারির কারণে বিলম্বিত হয়েছিল। ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে কক্সবাজারে ২ জনের মৃত্যু হয়। সেই নির্বাচনে বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বিদ্রোহীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। ২১ জুন অনুষ্ঠিত ২০৪টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের সময়ও পরিস্থিতি একইরকম ছিল।
এসডব্লিউ/এসএস/১১০০
আপনার মতামত জানানঃ