করোনার কারণে গত বছর জলবায়ু কিছুটা স্বস্তিতে ছিল। কার্বনসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমে যাওয়ায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার শঙ্কা ছিল না বললেই চলে। রাস্তায় গাড়ি কম, কারখানায় নেই উৎপাদন আর মানুষের ভোগ্যপণ্যের জোগানও তেমন বেশি দেখা যায়নি। এত কিছুর পরও গত বছর বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্বে নতুন রেকর্ড হয়েছে। যার ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি নাগালের মধ্যে রাখতে পারেনি বিশ্ব। সোমবার জাতিসংঘের আবহাওয়া বিষয়ক সংস্থা-ডব্লিউএমওর এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
জাতিসংঘের প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে রেকর্ড উষ্ণতম বছর পার করেছে এশিয়া। এই মহাদেশের উন্নয়নেও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে চরম বৈরী আবহাওয়া। এই মহাদেশের উন্নয়নেও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে চরম বৈরী আবহাওয়া।
জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) তাদের বার্ষিক ‘এশিয়া জলবায়ু পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছে, এই অঞ্চলের প্রত্যেকটি অংশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
ডব্লিউএমও বলছে, চরম বৈরী আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০২০ সালে এশিয়াজুড়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি, লাখ লাখ মানুষ বাস্ত্যুচুত এবং অবকাঠামো ও বাস্ত্যুসংস্থানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় শত শত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। খাদ্য ও পানির নিরাপত্তাহীনতা, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং পরিবেশের অবনতির কারণে টেকসই উন্নয়ন হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।’
আগামী রোববার স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জলবায়ু বৈঠকে বিপজ্জনক স্তরের উষ্ণতা এড়ানোর লক্ষ্যে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে জানায় আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইডের মাত্রা প্রতি ১০ লাখে ৪১৩ অংশে বেড়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে গত বছর বিশ্বজুড়ে লকডাউনের সময় সাময়িকভাবে নিঃসরণ কমলেও, বিগত এক দশকে গড় তাপমাত্রার তুলনায় গত এক বছরের তাপমাত্রা বেশি ছিল।
ডব্লিউএমও মহাসচিব পেতেরি তালাস বলেন, গ্রিনহাউস গ্যাসের বর্তমান হারের ফলে ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির সীমার চেয়েও তাপমাত্রা অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে। ওই চুক্তিতে তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল।
পেতেরি তালাস বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য থেকে এখনো অনেক দূরে। আমাদের শিল্প, জ্বালানি এবং পরিবহন ব্যবস্থা এবং পুরো জীবনযাত্রার পুনর্বিবেচনা করতে হবে।’ এ ছাড়া রোববার শুরু হতে যাওয়া ‘কপ২৬’ সম্মেলনকে সামনে রেখে এটিকে ‘নাটকীয় বৃদ্ধি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে জলবায়ু সম্মেলন আয়োজনের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। প্যারিস চুক্তিতে নির্ধারিত ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৈশ্বিক উষ্ণতা সীমাবদ্ধ রাখতে বিশ্বের শেষ সুযোগ হতে পারে এটি।
এদিকে আসন্ন জলবায়ু সম্মেলন নিয়ে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, এটা খুবই কঠিন সম্মেলন হতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমি খুবই চিন্তিত কারণ এটা আমার ভুলও হতে পারে যে, শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী হয়তো চুক্তিটি নাও হতে পারে।’
এই মুহূর্তে বিশ্বের অনেক সমস্যা রয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম হলো— বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক জীবিকার ওপর প্রভাব এবং বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা।
২০২০ সালে বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইডের মাত্রা প্রতি ১০ লাখে ৪১৩ অংশে বেড়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে গত বছর বিশ্বজুড়ে লকডাউনের সময় সাময়িকভাবে নিঃসরণ কমলেও, বিগত এক দশকে গড় তাপমাত্রার তুলনায় গত এক বছরের তাপমাত্রা বেশি ছিল।
এর আগে গত শনিবার সৌদি আরবের যুবরাজ বলেছেন, বিশ্বের শীর্ষ তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো ২০৬০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ‘শূন্যে’ নামিয়ে আনতে চায়। তিনি বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে নির্গমন হ্রাসের পরিকল্পনা দ্বিগুণ হবে।
কানাডার অটোয়ায় প্রকাশিত এক সরকারি পরিকল্পনায় জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোকে ২০২৩ সালের মধ্যে ১ হাজার কোটি ডলার সহায়তা করতে পারবে বলে আশাবাদী উন্নত দেশগুলো।
এই লক্ষ্যে কীভাবে পৌঁছানো যায় তার একটি যৌথ পরিকল্পনা করেছে কানাডা এবং জার্মানি। সেখানে বলা হয়েছে, উন্নত দেশগুলোর এখনো অনেক কিছু করার আছে। তাদের অভিযোগ ব্যক্তিগত অর্থায়ন প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্য পর্যায়ে নামিয়ে আনবে দেশটি। চলতি সপ্তাহের শনিবার সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছেন, সৌদি আরব কার্বন নিঃসরণ শূণ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনবে ২০১৬ সালে।
অস্ট্রেলিয়ার মন্ত্রিসভাও সোমবার এক বৈঠকে ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্য পর্যায়ে নামিয়ে আনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে এক বিৃবতিতে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন।
২০০৯ সালে বিশ্বের ধনী দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা করতে অনুন্নত দেশগুলোকে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়া হবে; কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যার্থ হয়েছে তারা।
রয়টার্সের অর্থনীতিবিদদের প্যানেল সম্প্রতি হিসেব কষে দেখিয়েছেন, প্রতি বছর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খাতে উন্নত দেশগুলো যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে, তার মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ দিয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে বিশ্বকে আরো অনেক বেশি সবুজ করে তোলা সম্ভব।
সম্প্রতি দ্য ক্লাইমেট ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্ট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের ২০টি ধনী দেশে কার্বন নিঃসরণের হার বেড়েই চলেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধনী ও উন্নত দেশগুলোর জোট জি-২০-এর সদস্য দেশগুলোতে এ বছর কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন ৪ শতাংশ বাড়বে। গত বছর করোনা মহামারির কারণে এসব দেশে কার্বন নিঃসরণের হার ৬ শতাংশ কমেছিল। এ বছর চীন, ভারত এবং আর্জেন্টিনাও তাদের ২০১৯ সালের কার্বন নির্গমন মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে।
প্রতিবেদনে জি-টোয়েন্টি দেশগুলোতে কয়লার ব্যবহার এ বছর পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য দায়ী থাকবে চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতেও কয়লার ব্যবহার বাড়ছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে জোরেশোরে এগোতে থাকায় চীনে জ্বালানি চাহিদা বেড়েছে। তাই সেখানে কয়লার ব্যবহারও বাড়তে দেখা গেছে। সঙ্গে বেড়েছে দামও। গত বছরের তুলনায় কয়লার দাম ২০০ শতাংশ বেড়েছে।
ক্লাইমেট ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জি-টোয়েন্টি দেশগুলোতে গ্যাসের ব্যবহার ১২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
রাজনৈতিক নেতারা কোভিডের ধাক্কা থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সবুজের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ধনী দেশগুলো বাস্তবে সে পথে হাঁটেনি। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যে ১৮০ কোটি ডলার খরচের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে মাত্র ৩০ কোটি ডলার সবুজ প্রকল্পের জন্য রাখা হয়েছে।
প্রতিবেদনে ধনী দেশগুলোতে সৌর এবং বায়ুশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির বিষয়টিও উঠে এসেছে। গত বছর জি-টোয়েন্টি দেশগুলোতে রেকর্ড পরিমাণ সৌর প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। ২০২০ সালে যেখানে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ছিল ১০ শতাংশ, তা এ বছর ১২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শিল্প বিপ্লব শুরুর আগে বিশ্বের যে তাপমাত্রা ছিল তার থেকে বৃদ্ধির মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা গেলে বড় ধরনের বিপদ এড়ানো যাবে। তা না পারলে বিপজ্জনক হয়ে পড়বে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, পৃথিবীর আবহাওয়া পাল্টে যাবার কথা অনেকদিন থেকেই আলোচনায়। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছিলেন। ওজোনস্তর ফুটো হয়ে যাবার কথাও অনেক পুরোনো। কিন্তু সেই পুরোনো কথার গুরুত্ব কেউ দেয়নি। আর দিলেও তা যে যথাযথভাবে দেওয়া হয়েছে, এমন বলার সুযোগ নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করার কাজটি নিয়ে যত সময়ক্ষেপণ হবে, মতানৈক্য থাকবে, তত বেশি মোকাবেলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি এড়ানোর পথ একটাই, সেটা হল শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোকে এক টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৮
আপনার মতামত জানানঃ