গত বছরের শুরুর দিকেই আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ) এক পূর্বাভাসে সতর্ক করে দিয়েছিল, গত বছর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ রেকর্ড ছাড়াবে। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের নিঃসরণ গত বছরে শুধু বাড়বেই না, বৃদ্ধির দিক থেকে এটি হবে ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম।
সংস্থাটির পক্ষ থেকে সতর্ক করে বলা হয়েছিল, ১০ বছর আগে ব্যাপক আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে বিশ্ব। ওই ঘটনার পর এই প্রথম কার্বন নিঃসরণের হার এতটা বাড়তে যাচ্ছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে, সেটি আগামীতে আরও বাড়বে।
গত বছরের পূর্বাভাসই যেন সত্য হলো। গত বছরে সারা বিশ্বে যে পরিমাণে বাতাসে বিষ মিশিয়েছে সভ্যতা, তা একটি সর্বকালীন রেকর্ড। মহামারির আগের বছরগুলিতেও কখনও বাৎসরিক এই পরিমাণে বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন হয়নি, যা হয়েছে ২০২১-এ। খবর রয়টার্স
আন্তর্জাতিক শক্তি এজেন্সি (আইইএ)-র রিপোর্টে মঙ্গলবার এই উদ্বেগজনক খবর দেওয়া হয়েছে। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, শুধু ২০২১ সালেই বিশ্বে বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের নির্গমনের হার বেড়েছে ছয় শতাংশ। আগের বছরগুলির তুলনায় গত বছরে বিশ্বে তিন হাজার ৬৩০ কোটি মেট্রিক টন ওজনের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস বাতাসে মিশেছে। যা একটি সর্বকালীন রেকর্ড।
কেন হঠাৎ এই ভাবে বেড়ে গেল কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন? তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আইইএ-র রিপোর্ট জানিয়েছে, মহমারি শুরুর পর দেশে দেশে লকডাউন জারি হওয়ায় আর তা দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় গোটা বিশ্বের অর্থনীতির যে নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল, তার থেকে দ্রুত রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে কয়লা পুড়িয়ে জ্বালানি তৈরি করে শিল্পক্ষেত্রগুলির থমকানো রথের চাকা গড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। দেশগুলি সে জন্য যে যত পারে কয়লা উত্তোলন করেছে ও পুড়িয়েছে। কয়লা পোড়ানোয় বাড়তি উৎসাহ জুগিয়েছে বিশ্বে ২০২০ সালের শেষ দিক থেকেই প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি। যা জীবাশ্ম জ্বালানিকে আরও বেশি পরিমাণে কয়লা-নির্ভর করে তুলেছে। যা বিশ্ব পরিবেশের পক্ষে আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে শুধু একটি বছরেই সর্বকালীন রেকর্ড মাত্রার কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমনের মাধ্যমে।
মহামারির আগের বছরগুলিতেও কখনও বাৎসরিক এই পরিমাণে বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন হয়নি, যা হয়েছে ২০২১-এ।
আইইএ-র রিপোর্টে এও বলা হয়েছে, ‘গত বছরেই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বেড়েছে অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহারও’। তবু তারপরেও দেশগুলির অতিমারিতে মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলার মরিয়া চেষ্টা মূলত কয়লা-নির্ভর জ্বালানির উপর বিশ্বাস রাখায় বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের মাত্রা সর্বকালীন রেকর্ড গড়তে পেরেছে।
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে গত বছর বিশ্বের অনেক দেশে কঠোর লকডাউন দেয়া হয়। ওই সময় কার্বন নিঃসরণ রেকর্ড সাত শতাংশ কমে যায়। কিন্তু লকডাউন উঠে যাওয়ার পর বছরের শেষের দিকে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ আগের জায়গায় ফেরত আসে। কয়েকটি জায়গায় তা ২০১৯ সালের পরিমাণকেও ছাড়িয়ে যায়।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করার কাজটি নিয়ে যত সময়ক্ষেপণ হবে, মতানৈক্য থাকবে, তত বেশি মোকাবেলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি এড়ানোর পথ একটাই, সেটা হল শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোকে এক টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে অবশ্যই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
তারা বলেন, একটি তথ্য হল, কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পর তা শোধন করে সবুজ গাছগাছালি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আমাদের এ পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ার একটি প্রধান কারণ হল জীবাশ্ম গ্যাস, যাকে আমরা বলি গ্রিনহাউস অ্যাফেক্ট। বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো-কার্বন, মিথেন ও অন্যান্য গ্যাস এত বেশি বেড়ে গেছে যে, এর পরিমাণ গত দেড় লাখ বছরে যা ছিল, তার চেয়েও এখন অনেক বেশি। আমাদের মানতে হবে, এটি এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। মানুষ তার প্রয়োজনেই উজাড় করছে গাছ।
তারা বলেন, বেড়ে গেছে কাঠের বহুমুখী ব্যবহার। মানুষ এ প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে নির্বিচারে উজাড় করছে বৃক্ষ। বনাঞ্চল হয়ে পড়ছে সংকুচিত। ফলে বায়ুমণ্ডলে ভেসে বেড়ানো গ্যাসগুলো পুরোটা পরিশোধিত হতে পারছে না। প্রতি মুহূর্তেই বেড়ে চলেছে অপরিশোধিত গ্যাসের পরিমাণ। আজ শোধন করার মতো প্রয়োজনীয় গাছগাছালির রয়েছে প্রকট ঘাটতি। ফলে অপরিশোধিত অতিরিক্ত গ্যাস বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
তার ওপর আবার কিছু কিছু রাসায়নিক স্ট্রাটোস্ফিয়ারে পৌঁছে ওজন স্তরকে করছে ক্ষতিগ্রস্ত। ওজন স্তরের ক্ষতি হওয়া মানে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি ভূপৃষ্ঠে এসে পড়া। এতে জীব ও উদ্ভিদ জগতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। প্রকৃতির শৃঙ্খলিত নিয়ম ভেঙে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণ হয়ে উঠেছে পরিষ্কার।
বায়ু মন্ডলের উঞ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টি বৈশ্বিক। তাই শুধুমাত্র কয়েকটি দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ালেই বিশ্বের উঞ্চতা হ্রাস পাবে না। কিছু কমতে পারে মাত্র। তাই বর্তমান বিশ্বের প্রধান ও প্রকট সংকট বায়ু মন্ডলের উঞ্চতা হ্রাস করার জন্য বিশ্বের সব দেশকেই একসাথে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং সবুজায়ন ও বৃক্ষ রোপন বৃদ্ধি করতে হবে বৈশ্বিক চাহিদা অনুযায়ী।নতুবা এ ক্ষেত্রে এসডিজি পূরণ হবে না। অপরদিকে জলবায়ু ফান্ডের প্রতিশ্রুত অর্থ দ্রুত পরিশোধ করা ও প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা করা এবং সে ফান্ড সঠিকভাবে ব্যবহার করা দরকার।
এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনের মন্তব্য স্মরণযোগ্য। মুন বলেছেন, ‘আমাদের যেহেতু দ্বিতীয় আরেকটি পৃথিবী নেই,তাই কার্বন নিঃসরণ কমাতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ ব্যতীত আর কোন উপায়ও নেই’।
অপরদিকে, ইউএনডিপি প্রধান বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের শক্তিশালি ও নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রয়োজন। মানব সমাজের উন্নয়নের কারণে পরিবেশ ও প্রকৃতিতে যে প্রভাব পড়ছে তা মোকাবিলায় এটি খুবই জরুরি’।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ অব্যাহত থাকায় এবং বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আমাদের উন্নয়নের ধারণা আবারও নির্দিষ্ট করা উচিৎ’।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৩
আপনার মতামত জানানঃ