বাংলাদেশে প্রস্তাবিত জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই চট্টগ্রাম বিভাগে হওয়ার কারণে সেখানে বিশ্বের বৃহত্তম কার্বন বিপর্যয়ের ঝুঁকি রয়েছে বলে জানানো হয়েছে এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে।
গতকাল সোমবার(১৬ মে) মার্কেট ফোর্সেস, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ ‘চট্রগ্রাম অঞ্চলে জ্বালানি পরিকল্পনা: সম্ভাব্য কার্বন বিপর্যয়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পের এই বিশাল সম্প্রসারণ প্রধানত জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে অর্থায়ন করা হবে। চট্টগ্রামের প্রস্তাবিত ২০ গিগাওয়াট নতুন কয়লা ও গ্যাস বিদ্যুৎ ক্ষমতার বিরূপ প্রভাবের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
যাতে বলা হয়েছে— বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কর্মক্ষমকালে বায়ুমণ্ডলে ১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন টন পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড যোগ হবে। অনুমান করা হচ্ছে, বিশাল নির্মাণ প্রকল্পগুলো স্থানীয় বাস্তুবিদ্যা, জলপথ, সম্প্রদায়, জীবিকা, স্বাস্থ্য এবং সেই সঙ্গে জলবায়ুর জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মাতারবাড়ি-২, জাপানি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিকল্পিত একটি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র। যা যুক্তিযুক্তভাবে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা। মাতারবাড়ি-১ ও ২ যদি নির্মিত হয়, তাহলে প্রকল্পগুলোর বায়ু দূষণের ফলে স্বাস্থ্যগত প্রভাবগুলো তাদের কর্মক্ষম বছরগুলোতে আনুমানিক ৬ হাজার ৭০০ জনের অকাল মৃত্যু ঘটাবে। প্রকল্পটি বিদেশি কয়লা অর্থায়ন বন্ধ করার জন্য জাপানের ২০২১ সালের জি৭ প্রতিশ্রুতিরও বিরোধিতা করে।
চট্টগ্রামে প্রকল্পের মূল উদ্যোক্তা, মিতসুবিশি করপোরেশন, জেরা-এর মালিক টেপকো এবং চুবু, সেই সঙ্গে এসএমবিসি গ্রুপ, সবাই সামনের সপ্তাহগুলোতে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তাদের নেট জিরো অঙ্গীকারের সঙ্গে এই ধরনের কার্বনঘন প্রকল্পগুলোর সামঞ্জস্যতা সম্পর্কে প্রকাশের দাবির সম্মুখীন হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।
এ ছাড়া ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রস্তাবিত এলএনজি থেকে বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর জন্য প্রতি গিগাওয়াটে গড়ে ৯৬০ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে এবং সেটা শুধু চট্টগ্রামের জন্য ১৬ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছাবে। যা প্রতিকূল প্রভাবগুলো প্রশমিত করার জন্য বাংলাদেশের ২০২২ সালের জলবায়ু পরিবর্তনের বাজেটের চেয়ে ৬ গুণ বেশি।
বাংলাদেশে ইতোমধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ওভার ক্যাপাসিটির সমস্যা রয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০-২০২১ সালে স্থাপন করা সক্ষমতার প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যবহার করা হয়নি।
বিশাল নির্মাণ প্রকল্পগুলো স্থানীয় বাস্তুবিদ্যা, জলপথ, সম্প্রদায়, জীবিকা, স্বাস্থ্য এবং সেই সঙ্গে জলবায়ুর জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) অনুসারে, গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এবং প্রকৃত চাহিদার মধ্যে ব্যবধান ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে, উদপাদন ক্ষমতার ব্যবহার পরবর্তী ৫ বছরে ৪০ শতাংশের নিচে নেমে যাওয়ার ধারণা করা হয়েছে।
এ ছাড়া কম চাহিদা এবং ট্রান্সমিশন অবকাঠামো নির্মাণে বিলম্বের কারণে বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালে কম ব্যবহারযোগ্য বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতার জন্য কোম্পানিগুলিকে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন প্রদান করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, নতুন পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কয়েক মাস ধরে পূর্ণক্ষমতায় কাজ করেনি। এর বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর পর থেকে জুন ২০২১ পর্যন্ত অলস বসে থাকার জন্য এর মালিকরা প্রায় ১১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পেয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে (বিপিডিবি) বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের মারাত্মক ব্যয়ের জন্য মূল্য বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছে, যা বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের কাছে বাংলাদেশের অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা সংকটের আর্থিক বোঝা স্থানান্তরিত করে।
আইইইএফএর মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি আমদানি করা জ্বালানি থেকে একটি অস্থিতিশীল মূল্যের বাজারে উন্মোচিত হবে। যদি এই প্রকল্পগুলো এগিয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের জনগণ আর্থিক ঝুঁকির মুখে পড়তে বাধ্য হবে, যেটা বিদেশি বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের বহন করা উচিত ছিল।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, বাংলাদেশিরা সাশ্রয়ী মূল্যের জ্বালানিতে বিনিয়োগ চায়, দূষিত এবং ব্যয়বহুল এলএনজিতে নয়।
জাপান সেন্টার ফর সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোসাইটির প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ইউকি তানাবে বলেন, জলবায়ুর ক্ষতির দিক বিবেচনা করে সুমিতোমো করপোরেশন মাতারবাড়ী-২ কয়লা প্রকল্প থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় বর্ষাকাল আসছে আরও বেশি বৃষ্টি, আরও বেশি বিপদ নিয়ে। সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশবিজ্ঞানীরাও বলছেন, এদেশেও বর্ষাকাল বদলে যাচ্ছে। আগে বর্ষাকাল একটা সাইকেল বা চক্র মেনে চলত। এখন সেটা দেখা যাচ্ছে না।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় মৌসুমি বৃষ্টিপাতের মাত্রার সঙ্গে এখানকার বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতির যোগসূত্র রয়েছে। শুরু থেকেই জলবায়ুগতভাবে অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে পৃথিবী। পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে উপমহাদেশের জলবায়ুও।
গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, গত নয় লাখ বছর ধরে এখানে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের মাত্রা অনেকটাই নির্ভর করেছে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি, পৃথিবীতে বরফের উপস্থিতি, আবহাওয়ার স্যাঁতসেঁতে ভাব, ভারত মহাসাগর থেকে ভেসে আসা আর্দ্রতা ও দক্ষিণ গোলার্ধ্বের ভূগঠনের ওপর। এর ভিত্তিতে সম্ভাব্য জলবায়ু মডেল তৈরি করে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সামনের দিনগুলোয় মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে।
গবেষকরা দেখতে পান, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি ও বিশ্বব্যাপী বরফের পরিমাণ হ্রাসের ধারাবাহিকতায় মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেড়েছে। এছাড়া পৃথিবীর কক্ষপথে সাময়িক পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন গোলার্ধ্বে সূর্যরশ্মির তীব্রতায়ও পরিবর্তন এসেছে। তবে এর মধ্যে কোনোটিকেই বৃষ্টিপাতের মাত্রা বদলের কারণ হিসেবে এককভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে বিষয়গুলোকে এক করে বিশ্লেষণের পরেও দেখা যাচ্ছে, মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণের সঙ্গে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধিজনিত উষ্ণায়নের এক ধরনের সংযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু মডেলগুলো আমাদের বলছে, উষ্ণায়িত পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণও হয় বেশি। সাধারণভাবে বলতে গেলে, এখন যেসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়, সেগুলোয় ভবিষ্যতে বৃষ্টিপাত হবে আরো বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে আমরা এ ভবিষ্যৎই দেখতে পাচ্ছি।
তারা বলেন, কখনও হঠাৎ ভারি বর্ষণ আবার কখনও প্রকৃতি উষ্ণ হয়ে উঠছে। এখন প্রতিদিন যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে, এটা কাছাকাছি অন্যান্য কয়েক বছরে দেখা যায়নি। গত কয়েক বছর ধরে আবহাওয়া স্বাভাবিক আচরণ করছে না। এর কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। আবার বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশেও বর্ষা তার রূপ বদলাতে পারে। অতিবর্ষণ হতে পারে। এতে বিপদ বাড়তে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫৪
আপনার মতামত জানানঃ