সড়ক দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের নিহতের সংখ্যাও বাড়ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় চলতি বছরের ৯ মাসে (জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর) পুলিশের ৪৬ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৬১ সদস্য নিহত হয়েছেন।
পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনেকসময় সঠিকভাবে ট্রাফিক আইন মেনে চলেন না। মোটরসাইকেল চালানোর সময় হেলমেট পরিধান না করা দুর্ঘটনায় হতাহতের অন্যতম কারণ। এছাড়া সড়কে পুলিশ কর্তৃক যানবাহনের কাগজপত্র যাচাই, জরিমানা, মামলা দায়ের ও অন্যান্য কারণে পুলিশের প্রতি চালকদের মনে বিরক্তিভাব তৈরি হওয়াকেও দায়ী করছেন অনেকেই।
জানা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর ৬১ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে এককভাবে পুলিশ বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছেন ৪৬ জন, অর্থাৎ ৭৫.৪০ শতাংশ। গত ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ২২ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছিলেন। এই হিসেবে চলতি বছরের ৯ মাসে নিহতের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৫২.১৭ শতাংশ।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৯ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশ বাহিনীর সদস্য ৪৬ জন, সেনাবাহিনীর সদস্য ৪ জন, নৌ-বাহিনীর সদস্য একজন, র্যাব সদস্য ৩ জন, বিজিবি সদস্য ২ জন, এনএসআই সদস্য একজন, এপিবিএন সদস্য একজন এবং আনসার ব্যাটালিয়ন সদস্য ৪ জন নিহত হয়েছেন।
পুলিশের মোটরসাইকেলে ট্রাকের ধাক্কা ও চাপায় ২৮ জন (৬০.৮৬ শতাংশ), পুলিশের মোটরসাইকেলে বাসের ধাক্কা ও চাপায় ৮ জন (১৭.৩৯ শতাংশ), পুলিশের মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ৪ জন (৮.৬৯ শতাংশ) এবং পথচারী হিসেবে হাঁটার সময় ও সড়কে দায়িত্ব পালনকালে যানবাহনের ধাক্কায় ৬ জন (১৩.০৪ শতাংশ) নিহত হয়েছেন।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, মহাসড়কে ২৫ জন (৫৪.৩৪ শতাংশ), আঞ্চলিক সড়কে ৯ জন (১৯.৫৬ শতাংশ), রাজধানীসহ অন্যান্য শহরের সড়কে ১১ জন (২৩.৯১ শতাংশ) এবং সদরঘাট নৌ-টার্মিনালে দায়িত্ব পালনকালে পানিতে পড়ে একজন (২.১৭ শতাংশ) নিহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, সকালে ৮.৬৯ শতাংশ, দুপুরে ১৩.০৪ শতাংশ, বিকালে ১৫.২১ শতাংশ এবং রাতে ৬৩.০৪ শতাংশ নিহতের ঘটনা ঘটেছে।
দুর্ঘটনার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন দেশে সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর না থাকাকে দায়ী করছে। এর পাশাপাশি পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঠিকভাবে ট্রাফিক আইন মেনে না চলা, মোটরসাইকেল চালানোর সময় পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্যের হেলমেট ব্যবহার না করা এবং বিশ্রামহীনভাবে ড্রাইভিংয়ের কারণে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চালকদের মানসিক অসুস্থতা, বেখেয়ালী ও বেপরোয়া মনোভাব উল্লেখযোগ্য।
প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ দিয়েছে রোড সেফটি। এর মধ্যে রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ট্রাফিক আইন মেনে চলতে উৎসাহিত করতে হবে, সড়ক পরিবহন আইন পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, আইনটি সকল নাগরিকের ক্ষেত্রে সমান ও বাধাহীনভাবে প্রয়োগ করতে হবে ও টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সাত বছরে ঝুলে থাকার পর ২০১৮ সালে জেল-জরিমানা বাড়িয়ে কঠোর সড়ক পরিবহন আইন করা হয়। কিন্তু পরিবহন মালিক শ্রমিকদের দাবিতে আইনটি শিথিল করা হচ্ছে। শাস্তি কমিয়ে করা সংশোধনের খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে রয়েছে। সড়কে নিয়ম ভঙ্গে জেল-জরিমানা কমবে।
তবে আইনের সুফল নেই। হাইওয়ে পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সড়কে মৃত্যু ও দুর্ঘটনা বেড়েছে আগের বছরের তুলনায়। গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে দুই হাজার ২৯১ দুর্ঘটনায় দুই হাজার ২২১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে তিন হাজার ২৫৯ দুর্ঘটনায় তিন হাজার ৯৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনা বেড়েছে ৪২ শতাংশ। মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি নামে একটি বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ছয় বছরে ৩১ হাজার ৭৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৯১ হাজার ৩৫৮ জন। ২০১৫ সালে আট হাজার ৬৪২ জনের মৃত্যু হয়। ২০২০ সালে করোনার লকডাউনে ৬৭ দিন যান চলাচল বন্ধ থাকলেও ছয় হাজার ৬৮৬ জনের মৃত্যু হয়েছে সড়কে।
জাতিসংঘের সড়ক নিরাপত্তা দশকের ঘোষণা অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অঙ্গীকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীর সদস্যদের সড়ক দুর্ঘটনায় এমন ব্যাপক সংখ্যক নিহতের ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। পুলিশ সদস্যদের নিহতের সংখ্যাই বলে দিচ্ছে দেশে সড়ক নিরাপত্তা বলে তেমন কিছু নেই। অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলের সঙ্গে পণ্যবাহী যানবাহনের সংঘর্ষে। মূলত সড়কে পণ্যবাহী ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, কাভার্ডভ্যান এবং মোটরসাইকেল এখন মরণদূত হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো কার্যকর ও টেকসই পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়।
তারা বলেন, সড়কে দায়িত্ব পালন ও চলাচলের ক্ষেত্রে পুলিশের নির্দেশনা রয়েছে, নিজের জীবন নিরাপদ করার নির্দেশনা রয়েছে। যারা মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন তারা যেন সাবধানতার সঙ্গে মোটরসাইকেল চালান, আইনগতভাবেই হেলমেট পরার নিয়ম তাই জীবন রক্ষার জন্য হেলমেট পরা অত্যন্ত জরুরি।
সড়কে নিরাপদে চলাচলের জন্য ও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নিয়মিতভাবে পুলিশ সদস্যদের ব্রিফিং দেওয়া উচিত। মোটরসাইকেলে দুজনের বেশি চলাচল না করা, গতিসীমা ঠিক রাখা, সঠিক লেন ব্যবহার করা ও ওভারটেকিং সাবধানে করা ছাড়াও পরিবহন আইনের যে ধারা বা নিয়মগুলো রয়েছে সেসব বিষয়ে পুলিশ সদস্যদের সচেতন করতে হবে। ট্রাফিক ছাড়াও পুলিশের অন্যান্য ইউনিটগুলোকেও এসব বিষয়ে নির্দেশনা দিতে হবে।
আজ (২২ অক্টোবর) জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তৃতীয় বারের মতো দিবসটির উপলক্ষে দেশব্যাপী নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘গতিসীমা মেনে চলি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করি’। দিবসটি পালনে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
আজ জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস
আজ (২২ অক্টোবর) জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তৃতীয় বারের মতো দিবসটির উপলক্ষে দেশব্যাপী নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘গতিসীমা মেনে চলি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করি’। দিবসটি পালনে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশে এ তৃতীয় বারের মতো দিবসটি পালিত হবে। এরমধ্যে রয়েছে ক্রোড়পত্র প্রকাশ, আলোচনা সভা, র্যালি ও সড়ক সচেতনতা কার্যক্রম। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য- ‘জীবনের আগে জীবিকা নয়, সড়ক দুর্ঘটনা আর নয়।’ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দিবসের শুরুতে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে সাতটায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা থেকে বর্ণাঢ্য র্যালি বের হবে। সকাল দশটায় ফার্মগেটস্থ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
এতে আরও বলা হয়, বিকেল চারটায় রাজধানীর বিভিন্ন বাস টার্মিনালসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হবে। এর পাশাপাশি পরিবহন মালিক, চালক, যাত্রী ও পথচারীদের সচেতন করার লক্ষ্যে বিতরণ করা হবে লিফলেট, পোস্টার ও স্টিকার।
এছাড়া গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিটিভিসহ বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনা ও বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশের সকল জেলা ও উপজেলায় এ দিবসে শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভিডিও চিত্র প্রদর্শনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক সংলাপ’ শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করা হয়।
এতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান জানান, সড়ক দুর্ঘটনায় যুবকদের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। ২০১৯ সালে তিন হাজার ৯৩৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে মারা যায় ৪ হাজার ৩৫৮ জন, আহত হন ৭ হাজার ২৪০ জন। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩২ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। আর চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতির পরিমাণ ২৯ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ঢাকাসহ সারা দেশে ২২২ স্পট ঠিক করা হলে দুর্ঘটনার ৪০ শতাংশই কমে আসবে। তবে আমাদের দাবি অনুযায়ী সর্বশেষ মাত্র ১২টি ঠিক করা হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য শুধু চালকদের দায়ী করলে হবে না। পথচারীও এখানে অনেকাংশে দায়ী। ফুটপাত না থাকলে পথচারীদের ডান পাশ দিয়ে হাঁটতে হবে। এছাড়া বেশকিছু নির্দেশনা আছে তা তারা মানেন না।
আজ থেকে ২৫ বছর আগের এই দিনে বান্দরবানে শুটিংয়ে থাকা স্বামী ইলিয়াস কাঞ্চনের কাছে যাওয়ার পথে চট্টগ্রামের অদূরে চন্দনাইশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন জাহানারা কাঞ্চন। সেই থেকে নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করে আসছেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। ‘পথ যেন হয় শান্তির, মৃত্যুর নয়’ এই স্লোগান নিয়ে গড়ে তুলেন সামাজিক সংগঠন— নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)। ২০১৭ সালের ৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই দিনটিকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণা করা হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ