করোনাভাইরাসের কারণে ৬৮ বছরে মধ্যে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে পাকিস্তান। গত বছরে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে এক মোড় পরিবর্তনের আশ্বাস দিয়েছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। কিন্তু করোনার ধাক্কায় পাকিস্তানের অর্থনৈতিক হাল এখন ১৯৫১-৫২ অর্থবছরের ন্যায়। দেশটির সাথে দেশটির প্রধানমন্ত্রীরও হাল যে বেশি একটা ভালো নয়, তা ইমরান খানের বিরুদ্ধে তোলা বিরোধীদলগুলোর এক অভিযোগে স্পষ্ট হয়ে আসে।
বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের তরফে পাকিস্তানকে দেওয়া বহু উপহার বিক্রি করেছেন পাকিস্তানের প্রধামন্ত্রী ইমরান খান। এমনই অভিযোগ করেছে পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো।
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তিনি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছ থেকে পাওয়া উপহারগুলো বিক্রি করে দিয়েছেন। এসব উপহারের মধ্যে ছিল ১০ লাখ ডলার মূল্যের উচ্চ দামের একটি ঘড়ি। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন এখবর জানিয়েছে।
রাষ্ট্র প্রধান ও সাংবিধানিক পদধারীদের রাষ্ট্রীয় সফরে উপহার বিনিময় স্বাভাবিক প্রথা। পাকিস্তানের উপহার সংরক্ষণ (তোশাখানা) নীতি অনুসারে, এসব উপহার রাষ্ট্রের সম্পদ হিসেবে থাকবে যত দিন না সেগুলো উন্মুক্ত নিলামে বিক্রি করা হয়।
আইনে সুযোগ রাখা হয়েছে কর্মকর্তা চাইলে বাজারমূল্যের চেয়ে ১০ হাজার রুপি কম দিয়ে উপহার নিজেদের কাছে কিনে রাখতে পারবেন।
পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট মরিয়ম নওয়াজ উর্দুতে টুইটারে লিখেছেন, অন্য দেশ থেকে পাওয়া উপহার বিক্রি করে দিয়েছেন ইমরান খান।
উৎখাত হওয়া প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে আরও লিখেছেন, খলিফা হজরত ওমর (রা.) তার শার্ট ও আলখেল্লার জন্য জবাবদিহি করেছেন। আর আপনি তোশাখানা লুট করেছেন এবং কথা বলছেন মদিনার মতো রাষ্ট্র গঠনের? একজন মানুষ কী করে এত অসংবেদনশীল, বধির, বোবা এবং অন্ধ হতে পারেন?
বিরোধী জোট পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) সভাপতি মাওলানা ফজলুর রহমান বলেছেন, জানা যাচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী খান একজন রাজকুমারের কাছ থেকে পাওয়া মূল্যবান একটি ঘড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। তার ভাষায়, এটি লজ্জাজনক।
তার দাবি, সম্প্রতি ইমরান পশ্চিম এশিয়ার কোনও একটি দেশের রাজার থেকে রত্নখচিত হাতঘড়ি উপহার পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি তিনি কয়েক কোটি টাকায় দুবাইয়ের এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন পোস্টে দাবি করা হচ্ছে, ঘড়িটির দাম প্রায় ১০ লাখ মার্কিন ডলার এবং তা উপসাগরীয় একজন রাজকুমার উপহার দিয়েছেন। ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি তা দুবাইয়ে বিক্রি করে টাকা তাকে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠছে। উপহার দেওয়া সেই রাজকুমারও ইমরান খানের ঘড়ি বিক্রি করে দেওয়ার বিষয়ে অবগত বলেও দাবি করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক যোগাযোগবিষয়ক বিশেষ দূত ড. শাহবাগ গিল বলেন, সাধারণত ইমরান খান এমন উপহার তোশাখানায় জমা দেন। তবে তিনি কোনও উপহার পেতে চান তাহলে তাকে দাম পরিশোধ করতে হবে।
নতুন পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান খান। তবে ইমরানের নেতৃত্বে পাকিস্তান নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে। সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য পরিচিত পাকিস্তানকে এই অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে বাইরে থেকে ৫১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন।
দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দ্বারা অনেক কাটছাঁটের পরও দেখা গিয়েছে ২০২১-২২ বছরে পঙ্গু পাকিস্তানের বাহ্যিক আর্থিক চাহিদা ২৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই পরিমাণটি ২৮ বিলিয়ন ডলার। বাইরের দেশের তহবিলের প্রয়োজনীয়তা কমাতে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা আইএমএফ-এর সঙ্গে চুক্তি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
জানা যায় যে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে পাকিস্তান বৈদেশিক ঋণের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় রয়েছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে এখন পাকিস্তান ডেবিট সার্ভিস সাসপেনশন ইনিশিয়েটিভ (ডিএসএসআই)-এর আওতায় এসেছে। এর মানে হল যে পাকিস্তানের এখন এত বেশি বৈদেশিক ঋণ রয়েছে যে এটি আর ধার নিতে পারবে না।
নতুন পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান খান। তবে ইমরানের নেতৃত্বে পাকিস্তান নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে। সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য পরিচিত পাকিস্তানকে এই অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে বাইরে থেকে ৫১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণ আট শতাংশ বেড়েছে। চলতি বছরের জুন মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় যাতে জানা যায় যে ইমরান সরকার বিশ্বব্যাংক থেকে ৪৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছে। এছাড়াও এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক পাকিস্তানকে ঋণ দিচ্ছে। এই বিশ্বব্যাপী ঋণদাতাদের সহায়তায় পাকিস্তানের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়। এই ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলি ভবিষ্যতে পাকিস্তানের রেটিং আরও কমিয়ে দিতে পারে।
প্রায় এক দশক ধরেই অর্থনৈতিক দুরাবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যয় সংকোচনের পথে হাঁটছে দেশটির সরকার। দেশটির বিকল্প আয়ের উৎস খুঁজে বের করতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেদেশের সরকার। এরইমধ্যে ইসলামাবাদে থাকা বাসভবনটি ভাড়া দেয়ার জন্য তোলা হয়েছে।
সরকারের খরচ কমাতে পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের রাজ্যপালদেরর জন্যও বেশ কয়েকটি ঘোষণা করা হয়েছে। খরচ কমানোর জন্য তারা রাজ্যপালের বাসভবনে আর থাকবেন না।
জানা গিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হয় ৪৭০ মিলিয়ন। এই বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ কমাতে ইমরান খানের বাসভবন খালি করা হয়েছে। খরচ কমানোর জন্য চলতি বছরের শুরুতে ৬১টি লাক্সারি গাড়িও নিলাম করে পাক সরকার।
মৌলবাদের উত্থানের পর পাকিস্তানের অর্থনীতির এখন এমন হাল হয়েছে যে জনকল্যাণমূলক খাতগুলোতে ব্যায়ের জন্য অর্থ নেই দেশটির সরকারের কাছে। দেশের এমন পরিস্থিতির মধ্যে এরকম প্রাসাদের মতো বাড়িতে থাকা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অনেক কটু কথাও শুনতে হয়েছিল। তিনি নিজেও জানিয়েছিলেন এটি তার পছন্দ নয়। এরপর থেকেই তিনি এই ভবন ছেড়ে নিজের বানি গালা বাসভবনে রয়েছেন এবং সেটিকেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছেন। যদিও ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর গত তিন বছরে পাকিস্তানের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়েছে ১৯ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫১
আপনার মতামত জানানঃ