দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার রেশ কাটিয়ে ওঠার আগেই গত রোববার রংপুরের পীরগঞ্জে অন্তত ৩টি গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ঘর-বাড়িতে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এর রেশ এখনো কাটেনি। এরইমধ্যে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কামদিয়া বাজারের এক হিন্দু কাপড় ব্যবসায়ীর দোকানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আগুন লাগানোর অভিযোগ উঠেছে। আজ মঙ্গলবার সকালে রমেশ চন্দ্র দাসের (৩৫) দোকানে আগুন লাগানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। দোকান মালিক রমেশ চন্দ্র দাশ কামদিয়া ইউনিয়ন পুজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক। এ ঘটনায় নগদ টাকা, কাপড়সহ দুইটি দোকানের ৫০ লক্ষাধিক টাকার মালামাল পুড়ে গেছে।
গোবিন্দগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়, পুলিশ ও প্রত্যদর্শীরা জানায়, স্থানীয় লোকজন ভোর পাঁচটার দিকে কামদিয়া বাজারের রমেশ চন্দ্র দাশের কাপড়ের দোকানে ধোঁয়া বের হতে দেখে। তারা গোবিন্দগঞ্জ ও ঘোড়াঘাট ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে আসার আগেই আগুন পুরো দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। এতে পাশের বিপ্লব আকন্দের কাপড়ের দোকানেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তার দোকানেরও আংশিক ক্ষতি হয়েছে। পরে ফায়ার সার্ভিসের গোবিন্দগঞ্জ ও ঘোড়াঘাট ইউনিটের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে দুই দোকানের নগদ টাকা, কাপড়সহ ৫০ লক্ষাধিক টাকার মালামাল পুড়ে গেছে।
দোকান মালিক রমেশ চন্দ্র দাশ বলেন, সাম্প্রতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে শক্রতাবশত তার দোকানে আগুন দেয়া হতে পারে। আগুনে তার দোকানের সবকিছু পুড়ে গেছে।
রমেশ চন্দ্র অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি কামদিয়া ইউনিয়নের পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক। বিপদে-আপদে আমি হিন্দু ভাইদের পাশে দাঁড়াই। এতে করে আমার বিরুদ্ধে অনেকের ক্ষোভ থাকতে পারে। দেশের চলমান ইস্যুতে কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে আমার দোকানে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে থাকতে পারে।’
রমেশ বলেন, ‘আমার এই দোকান (রবিন বস্ত্রালয় এবং গার্মেন্টস) ছাড়া আর কিছু নেই। দোকানটা পুড়িয়ে দিলো কেউ। আমার দোকানে প্রায় ৫০ লাখ টাকার কাপড় ছিল। দোকানে নগদ আড়াই লাখ টাকা রাতে রেখে গিয়েছিলাম। সব কিছু ১ ঘণ্টার মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিছুই নেই আর। আমি সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম।’
কীভাবে আগুন লেগেছে জানতে চাইলে রমেশ বলেন, ‘গতকাল রাত ৯টার পরে দোকান বন্ধ করে বাড়িতে যাই। আজ ভোর ৫টার সময় বাজার থেকে আমাকে ফোন করে একজন জানান, দোকানে আগুন লেগেছে। এসে দেখি আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। আমি যাওয়ার আগেই স্থানীয়রা ফায়ার সার্ভিসে ফোন করে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস যতক্ষণে পৌঁছায় তার আগেই স্থানীয়দের সহযোগিতায় আগুন নেভানো হয়। কিন্তু, আগুন নেভার আগেই সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দোকানের শাটারের নিচে একটু ফাঁকা জায়গা আছে তালা লাগানোর জন্য। আমার মনে হচ্ছে ওই দিক দিয়েছেই কেউ আগুন লাগিয়েছে।’
‘আমি কামদিয়া ইউনিয়নের পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক। বিপদে-আপদে আমি হিন্দু ভাইদের পাশে দাঁড়াই। এতে করে আমার বিরুদ্ধে অনেকের ক্ষোভ থাকতে পারে। দেশের চলমান ইস্যুতে কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে আমার দোকানে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে থাকতে পারে।’
রমেশের দোকান থেকে পাশের মো. বিপ্লব আকন্দের কাপড়ের দোকানেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
মো. বিপ্লব আকন্দ বলেন, ‘ভোর ৫টায় আমিও খবর পেয়ে এসে দেখি রমেশ দা’র দোকানে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। আমার দোকান থেকে সব মাল বের করা হলেও আগুনে আমার কিছু অবকাঠামো পুড়ে গেছে এবং ফায়ার সার্ভিসের পানিতে আমার অনেক কাপড় নষ্ট হয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রমেশ দা আর আমি দুই ভাইয়ের মতোই এখানে কাপড়ের ব্যবসা করতাম। কিন্তু কীভাবে কী হয়ে গেল বুঝতে পারছি না। আমার প্রায় আড়াই লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।’
বিপ্লব বলেন, ‘বৈদ্যুতিক কারণে আগুন লাগলে মিটার পুড়তো। পাশের ট্রান্সফরমার পুড়ত, কিন্তু সেগুলো ঠিক আছে। তার মানে আগুনের পেছনে অন্য কারণ থাকতে পারে।’
বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন গোবিন্দগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ।
তিনি বলেন, ‘পুড়ে যাওয়া দোকান ঘুরে দেখেছি। সেখানে শট সার্কিট বা দুর্ঘটনা থেকে আগুন লাগার কোনো আলামত দেখতে পাইনি। তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত দোকানি কামদিয়া ইউনিয়ন পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি হওয়ায় টার্গেটে ছিলেন। তাকে নিঃস্ব করতেই পরিকল্পিতভাবে আগুন সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে।’
এ বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক আরিফ আনোয়ার বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর। তদন্ত ছাড়া কিছু বলা যাচ্ছে না।
ঘটনাটি ঘোড়াঘাট ফায়ার সার্ভিসও তদন্ত করছে। এখানবার পরিদর্শক নিরঞ্জন সরকার বলেন, ফায়ার সার্ভিসের দিনাজপুর ও ঢাকার উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা তদন্ত করবেন। এর আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।
গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একেএম মেহেদী হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস, সিআইডি, পল্লী বিদ্যুৎ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানিয়েছে, দোকানের ভেতর থেকে সর্ট সার্কিট বা এই ধরনের কোনো কারণে আগুন লাগতে পারে। তবে দোকান মালিক অভিযোগ করেছেন, কেউ তার দোকানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’
এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে জেলা পূজা উদযাপন কমিটির নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি রনজিত বকসি বলেন, এটা নাশকতা। পিছন দিয়ে দোকানে আগুন লাগানো হয়েছে। তারা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি ও তাদেরকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে কোরআন অবমাননার অভিযোগ ওঠে, যার জেরে দেশজুড়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মণ্ডপ, মন্দির, বাড়িঘর এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়।
সহিংসতার ঘটনায় ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে চাঁদপুরের চারজন রয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে গত রোববার আবারও একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কমপক্ষে ২৯টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
ধর্মের নামে দেশে এ রকম অর্গানাইজড ক্রাইম এই প্রথম নয়। আগেও ঘটেছে কক্সবাজারের রামুতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে, সুনামগঞ্জের শাল্লায়। কিন্তু কোথাও এদের বিচার হয়নি। উল্টো সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর মামলার চার্জশিটভুক্ত ৩ আসামি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া, এটাই তাদের পরবর্তী অপরাধে সাহস যোগায়। শাল্লার ঘটনায় আমরা দেখলাম উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিবাদকারী যুবক ঝুমন দাস হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখায় আটক হয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও সহজে জামিন পাননি। কিন্তু অপরাধে সম্পৃক্ত স্বাধীন মেম্বাররা অনায়াসে ছাড় পেয়ে গেছেন। অথচ দেশজুড়ে হেফাজতি তাণ্ডবের জেরে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রই মামলা করে আটক করে রেখেছে।
তাঁরা বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের চোখ দিয়ে দেখলে সংখ্যালঘুর মন বোঝা যায় না। বিপরীত দিক থেকে ভাবলেই কিছুটা আন্দাজ করা যায়। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা যদি ভাবতেন যে তাদের ঈদ আনন্দের সময় শহরজুড়ে, পাড়াজুড়ে পাহারা দিচ্ছে পুলিশ, বিজিবি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিছু ধর্মোন্মাদ মানুষ একটা হুজুগ তুলে যেকোনো সময় হামলা করতে পারে। কেমন লাগতো তখন? সশস্ত্র পাহারা দিয়ে হয়তো সাময়িক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, কিন্তু আনন্দের স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশ তৈরি করা যায় না।
আরও বলেন, রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনায় প্রথম ও প্রধান শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। রাজনীতির হিসাব-নিকাশে বড় হয়ে ওঠে কারা তাদের ভোট পাবে, কারা পাবে না। নিরাপত্তা নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে। নব্বই ও বিরানব্বইয়ের পর ২০০১ সালে এবং রামু, সাথিয়া, নাসিরনগরের ঘটনায় এর প্রমাণ মিলেছে। নির্বাচিত দল বা সরকার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ঐ সময়ের বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বিশ্বসম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতে হয়েছে।
আমাদের দেশে যে কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় রাজনৈতিক মাঠ গরম থাকে বেশ কিছু দিন। পক্ষে-বিপক্ষে, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ চলতেই থাকে। সকল সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, সুশীল সমাজ রাস্তায় নামে এবং প্রতিকার খোঁজার চেষ্টা করে। তেমন সমাধান পাওয়া যায় না। মামলা হয়; কিন্তু বিচার হয় না। ফলে থামছে না নির্যাতনের ঘটনাও। অভিযোগ, নেপথ্যে ক্ষমতাসীনরা জড়িত থাকায় তাদেরকে আইনের আওতায় আনা যায় না। এবারের ঘটনাতেও ক্ষমতাসীনদের জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, ‘অপরাধী যেই হোক, তাকে বিচারের আওতায় আনা হবে’— এরকম আপ্তবাক্য মানুষ আর শুনতে চায় না। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত কোনো সংখ্যালঘু হামলা মামলার বিচার হয়নি, এটাই সত্য। ফলে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর জান-মালের নিরাপত্তার কোনো সুরাহা হয় না। নিরাপত্তাহীনতা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
এ দেশের সকল ধর্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য। এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি যুদ্ধ করে অর্জন করা। সেই মাটির অধিকার আমাদের সকলের। কেবল ধর্মের কারণে সেই অধিকারবোধ নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। যে কোনো মূল্যে এই ঐক্যের বোধ জাগ্রত রাখতে হবে। উন্নয়নের প্রকৃত সোপান সেখানেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ