সমুদ্র, নদী, পাহাড়ের মেলবন্ধন রয়েছে চট্টগ্রামে। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যের নগরীর পাহাড়গুলো একে একে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী ভূমিপুত্রদের কুনজরে হারিয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ পাহাড়। কেউ কাটছে কৌশলে, কেউ কাটছে দিনদুপুরে কিংবা রাতে। চট্টগ্রাম নগরীতে এ ধরনের অসংখ্য পাহাড়ের একটি বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার নাগিন পাহাড়। পরিবেশ অধিদপ্তর জরিমানা করে দায় সারলেও ঠেকানো যাচ্ছে না পাহাড় কাটা। আবার ধসে পড়া মাটিও রাতের আঁধারে সরিয়ে নেয় প্রভাবশালী এবং দুষ্কৃতকারীরা। এভাবে নাগিন পাহাড়ের আশেপাশে পাহাড়ি ভূমিতে তৈরি হচ্ছে একে একে অট্টালিকা।
দেড় লাখ বর্গফুট আয়তনের নাগিন পাহাড়ের দুই-তৃতীয়াংশ কেটে গত দুই দশকে গড়ে তোলা হয়েছে দুটি আবাসিক এলাকা। পাহাড়ের বুক চিরে গড়ে ওঠা এই আবাসনের নাম দেওয়া হয়েছে গ্রিনভ্যালি হাউজিং-১ ও ২, যেখানে ইতোমধ্যেই ৮০টি বহুতল ভবন ও শতাধিক কাঁচাবাড়ি উঠেছে। আবাসনের নামে এখনো সেখানে চলছে পাহাড় কাটা।
চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার টেক্সটাইল গেট থেকে পাঁচ মিনিট দূরত্বের এই স্থানটিতে জমি ও ফ্ল্যাট ক্রেতাদের চাহিদা বিপুল। এ চাহিদাকে সামনে রেখে আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সেখানে ব্যক্তিপর্যায়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বহুতল ভবন।
সম্প্রতি ‘নাগিন পাহাড়’ কেটে স্থাপনা নির্মাণের প্রমাণ পেয়ে গ্রিনভ্যালি হাউজিং-১ ও ২ আবাসিক এলাকার ৪৯ জন বাড়ির মালিককে ৬৪ লাখ ৭৮ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এছাড়া প্রায় এক লক্ষ ৮২ হাজার ৮৭৫ ঘনফুট পাহাড় কেটে ফেলার অভিযোগে ১০ জনের বিরুদ্ধে নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
স্থানীয়রা সংবাদমাধ্যমকে জানান, একসময়ে ইটভাটা ছিল পাহাড়টির পাদদেশে। পাহাড় কেটে ইটবানিয়ে বিক্রি করতেন এক প্রভাবশালী। পরে পরিবেশ আইনে দেশের মহানগরীগুলোতে কোন ইটভাটা না রাখার সরকারি ঘোষনা আসলে পরিবেশ অধিদপ্তর ইটভাটাটি গুঁড়িয়ে দেয়। তারপরেও নাগিন পাহাড়কে রক্ষা করা যাচ্ছে না।
আরও জানান, ‘এখানে চিপা একটি গলি ছিল। এখন অনেক বড় রাস্তা হয়ে গেছে। এখানে শাহাদাত কোম্পানির ব্রিকফিল্ড ছিল। পাহাড়টি কেটে ব্রিকফিল্ড বানানো হয়েছিল। এরপর থেকে পাহাড়টি ধসে পড়ছে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, নাগিন পাহাড়ের পূর্ব-দক্ষিণ পাশে গ্রিনভ্যালি হাউজিং- ২ এ ১২ হাজার ৯৬০ বর্গফুট পাহাড় কেটে ১১ তলা ভবন করেছেন মো. হাবিবউল্লাহ বাহার ও নাসির উদ্দিন। ৮৭৫ বর্গফুট পাহাড় কেটেছেন খোকন শিকদার, পূর্ব উত্তর পাশে ২ হাজার ৩৫০ বর্গফুট পাহাড় কেটে ৮ তলা ভবন করেছেন সাইফুল আলম সুমন, ১,৫০০ বর্গফুট পাহাড় কেটে ৫ তলা ভবন নির্মাণ করেছেন নুরুল আলম, ৩ হাজার বর্গফুট পাহাড় কেটে ৭ তলা ভবন নির্মাণ করেছেন মোহাম্মদ ইছা খান।
৬০০ বর্গফুট পাহাড় কেটে দুটি স্থাপনা নির্মাণ করেছেন মোহাম্মদ শফি উল্লাহসহ ছয়জন, এক হাজার বর্গফুট পাহাড় কেটে চারতলা ভবন করেছেন শহিদ উল্লাহ এবং পাহাড়ের পূর্ব-দক্ষিণ পাশে ১,৪০০ বর্গফুট পাহাড় কেটে ১৩টি ঘর নির্মাণ করেছেন মোতাহের হোসেন, এক হাজার ৫০০ বর্গফুট পাহাড় কেটে ১২টি টিনশেড ঘর স্থাপনা করেছেন নুরুল ইসলাম।
দেড় লাখ বর্গফুট আয়তনের নাগিন পাহাড়ের দুই-তৃতীয়াংশ কেটে গত দুই দশকে গড়ে তোলা হয়েছে দুটি আবাসিক এলাকা। পাহাড়ের বুক চিরে গড়ে ওঠা এই আবাসনের নাম দেওয়া হয়েছে গ্রিনভ্যালি হাউজিং-১ ও ২, যেখানে ইতোমধ্যেই ৮০টি বহুতল ভবন ও শতাধিক কাঁচাবাড়ি উঠেছে। আবাসনের নামে এখনো সেখানে চলছে পাহাড় কাটা।
২০১১ সালে চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা নিয়ে ‘হিল কাটিং ইন অ্যান্ড অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বেশিরভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার মতিঝর্ণা, ষোলশহর এবং ফয়’স লেকে।
১৯৭৬ থেকে ৩২ বছরে চট্টগ্রাম নগর ও আশেপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ১৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয় বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪ দশমিক ০২ বর্গকিলোমিটার। এ সময় ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়। এটা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। নগরের বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালি ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় এসব পাহাড় কাটা হয়। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ কাটা পড়ে পাঁচলাইশে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক মো. নূরুল্লাহ নূরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীতে নাগিন পাহাড় হচ্ছে একটি আলোচিত পাহাড়। পাহাড়টির পাদদেশে ইটভাটা ছিল। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবছর আগে ইটভাটাটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হলেও পাহাড়টি রক্ষা করা যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘এক পুলিশ অফিসারের পাহাড় কাটার অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে দেখেছি, নাগিন পাহাড়ের আশেপাশে বহুতল অনেক ভবন উঠেছে। ভবনগুলোর খতিয়ান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে সবগুলোই পাহাড় শ্রেণির। বিগত বেশ কয়েকবছর ধরে পাহাড়ি এ ভূমিতে দালানগুলো উঠেছে। দালানগুলো কিভাবে উঠেছে তা প্রশ্ন তৈরি করছে। আমরা সরেজমিনে দেখে কয়েকজনকে নোটিশ করেছি।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের এ পরিচালক জানান, ‘নাগিন পাহাড়ের পাশে ‘দিদার হাউজিং সোসাইটি’ নামের আবাসন গড়ে উঠেছে। দিদারুল আলম নামের ওই ব্যক্তি মারা গেছেন। ওখানে প্রায় দুই কানি জায়গার মালিক ছিলেন দিদার। পরে চার শতক জমির উপর ৭ তলা ভবন তৈরি করেন তিনি। অন্য সম্পত্তি কয়েকজনের কাছে বিক্রি করে দেন। তন্মধ্যে মান্নান নামের এক ব্যক্তিকে ৯০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আবারও ওই এলাকাটি ভিজিট করবো। ওখানে যতটুকু শুনেছি সিডিএ’র অনুমোদন নিয়েই বহুতল ভবনগুলো উঠেছে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন পুরো এলাকাটিতে নাগিন পাহাড়ের অবস্থান ছিল। পাহাড় শ্রেণির জমিতে সিডিএ কিভাবে বিল্ডিং করার অনুমোদন দিয়েছেন, সেটিও আমরা খতিয়ে দেখবো।’
পরিবেশবিদরা বলছেন, চট্টগ্রাম এলাকায় বর্ষাকালে প্রাণঘাতী ভূমিধস ও কাদার প্রবাহ নেমে আসার প্রধানতম কারণ হলো পাহাড় কাটা। এর বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগের বিষয়ে ঔদাসীন্য রয়েছে। এ ঔদাসীন্য কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন।
তারা বলেন, চট্টগ্রামের ঐতিহ্য পাহাড়। কিন্তু প্রশাসন ও বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়হীনতার কারণে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো দিন দিন দখলে গিয়ে বিলাসবহুল প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। কেউ দখল করে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে ভাড়া দিচ্ছে। আবার কেউ আবাসন প্রকল্পের নামে পাহাড় কেটে সুউচ্চ আবাসন ভবন তৈরি করে চড়া দামে বিক্রি করছে।
এ পাহাড়ের ওপর প্রকল্পগুলোর নকশা সিডিএ কিভাবে অনুমোদন দেয়, সেটাই অন্ধকারে রয়ে গেছে। নগরীর সৌন্দর্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পাহাড় সংরক্ষণ করা জরুরি।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, পাহাড় ও বন কাটার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বা পরিবেশ আদালতে মামলা করেই যেন পরিবেশ অধিদপ্তর দায়িত্ব শেষ। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং পাহাড় ধ্বংসকারীদের আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। জরিমানা ছাড়াও পাহাড় বেষ্টনী দিয়ে বনায়ন করতে হবে।
তারা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, সেগুলোতে একই অপরাধ বারবার হলে শাস্তির মাত্রা কয়েক গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পরিবেশ আইনে যদি এমন দুর্বলতা থাকে, তাহলে তা দূর করা এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ দ্রুতই পাহাড়শূন্য হয়ে যাবে, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল বলে কিছু থাকবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ