জলবায়ুর পরিবর্তন ও পরিবেশদূষণ রোধে কার্বন নিঃসরণ কমানো নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা চলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াল প্রভাব ঠেকাতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতির মধ্যেই বিশ্বের ধনী দেশগুলো থেকে দ্রুতগতিতে বাড়ছে কার্বন নিঃসরণ। নতুন একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ২০টি ধনী দেশে কার্বন নিঃসরণের হার বেড়েই চলেছে। ‘দ্য ক্লাইমেট ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্ট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। খবর বিবিসির
করোনার কারণে গত বছর জলবায়ু কিছুটা স্বস্তিতে ছিল। কার্বনসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমে যাওয়ায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার শঙ্কা ছিল না বললেই চলে। রাস্তায় গাড়ি কম, কারখানায় নেই উৎপাদন আর মানুষের ভোগ্যপণ্যের জোগানও তেমন বেশি দেখা যায়নি।
কিন্তু চলতি বছর সেই চিত্রটা পাল্টে গেছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে উঠেপড়ে লেগেছে বিশ্বের ধনী দেশগুলো। রাস্তায় বেড়েছে গাড়ি আর মানুষ, কারখানায় উৎপাদন এখন আগের চেয়ে কয়েকগুণ। এরই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণেও।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধনী ও উন্নত দেশগুলোর জোট জি-২০-এর সদস্য দেশগুলোতে এ বছর কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন ৪ শতাংশ বাড়বে। গত বছর করোনা মহামারির কারণে এসব দেশে কার্বন নিঃসরণের হার ৬ শতাংশ কমেছিল। এ বছর চীন, ভারত এবং আর্জেন্টিনাও তাদের ২০১৯ সালের কার্বন নির্গমন মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে।
১৬টি গবেষণা সংস্থা ও পরিবেশগত গোষ্ঠীর তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে জি-টোয়েন্টি দেশগুলোতে কয়লার ব্যবহার এ বছর পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য দায়ী থাকবে চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতেও কয়লার ব্যবহার বাড়ছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে জোরেশোরে এগোতে থাকায় চীনে জ্বালানি চাহিদা বেড়েছে। তাই সেখানে কয়লার ব্যবহারও বাড়তে দেখা গেছে। সঙ্গে বেড়েছে দামও। গত বছরের তুলনায় কয়লার দাম ২০০ শতাংশ বেড়েছে।
ক্লাইমেট ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জি-টোয়েন্টি দেশগুলোতে গ্যাসের ব্যবহার ১২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
রাজনৈতিক নেতারা কোভিডের ধাক্কা থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সবুজের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ধনী দেশগুলো বাস্তবে সে পথে হাঁটেনি। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যে ১৮০ কোটি ডলার খরচের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে মাত্র ৩০ কোটি ডলার সবুজ প্রকল্পের জন্য রাখা হয়েছে।
প্রতিবেদনে ধনী দেশগুলোতে সৌর এবং বায়ুশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির বিষয়টিও উঠে এসেছে। গত বছর জি-টোয়েন্টি দেশগুলোতে রেকর্ড পরিমাণ সৌর প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। ২০২০ সালে যেখানে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ছিল ১০ শতাংশ, তা এ বছর ১২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে উঠেপড়ে লেগেছে বিশ্বের ধনী দেশগুলো। রাস্তায় বেড়েছে গাড়ি আর মানুষ, কারখানায় উৎপাদন এখন আগের চেয়ে কয়েকগুণ। এরই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণেও।
রাজনৈতিকভাবেও জি-টোয়েন্টি গ্রুপগুলোতে কার্বন নিঃসরণ কমানো নিয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। জি-টোয়েন্টি-এর অধিকাংশ দেশ এ শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যের বিষয়টিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। গ্লাসগো সম্মেলনের আগেই এ জোটের সব সদস্য ২০৩০ সালের মধ্যে নতুন কার্বন পরিকল্পনা গ্রহণে সম্মত হয়েছেন। তবে চীন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও সৌদি আরব এ নিয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
গবেষকেরা বলছেন, জীবাশ্ম জ্বালানির অব্যাহত ব্যবহার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে হ্রাস করছে।
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠেয় জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন কপ-২৬ এর দুই সপ্তাহ বাকি। সম্মেলনের অন্যতম লক্ষ্য হলো, তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টিকে নাগালের মধ্যে রাখার পদক্ষেপ নেওয়া।
প্রাক-শিল্পযুগের তুলনায় বর্তমানে বিশ্ব এক দশমিক এক ডিগ্রি বেশি উষ্ণ। ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা বৃদ্ধিকে সীমাবদ্ধ রাখাটা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। নতুন গবেষণা প্রতিবেদনে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ধনী দেশগুলোর দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার তথ্য উঠে আসেনি।
বিবিসি বলছে, বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শিল্প বিপ্লব শুরুর আগে বিশ্বের যে তাপমাত্রা ছিল তার থেকে বৃদ্ধির মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা গেলে বড় ধরনের বিপদ এড়ানো যাবে। তা না পারলে বিপজ্জনক হয়ে পড়বে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, পৃথিবীর আবহাওয়া পাল্টে যাবার কথা অনেকদিন থেকেই আলোচনায়। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছিলেন। ওজোনস্তর ফুটো হয়ে যাবার কথাও অনেক পুরোনো। কিন্তু সেই পুরোনো কথার গুরুত্ব কেউ দেয়নি। আর দিলেও তা যে যথাযথভাবে দেওয়া হয়েছে, এমন বলার সুযোগ নেই।
বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা মানুষ শুনেছে। রাষ্ট্রপ্রধানরা তহবিল সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ফোরামের নানা আয়োজনে উত্তেজক কথাবার্তা বলে হাততালি নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। একে অন্যকে দোষারোপের সংস্কৃতিও রয়েছে। আর ধনী রাষ্ট্রগুলো যেভাবে কার্বন নিঃসরণ করছে, তার বিপরীতে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো রীতিমতো অসহায়। ফলে একদিকে দোষারোপের সংস্কৃতি, দরিদ্র দেশগুলোর আহাজারি, পৃথিবীব্যাপী সচেতন মানুষদের আর্তনাদ অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলে অবিচ্ছিন্নভাবে কার্বন নিঃসরণ চলতে থাকে। ফলে বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তাও ফলতে শুরু করেছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, হিমালয়ের বরফ গলছে। সেই পানি ধেয়ে আসছে সমুদ্রে। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। আর ওজোনস্তরের ফুটো বাড়তে থাকারও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
বিশ্বের তাপমাত্রার যে পরিবর্তন তাও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। পেছনের একশ বছরের তাপমাত্রা মিলিয়ে দেখে, বায়ুমণ্ডল এবং পৃথিবীপৃষ্ঠ উষ্ণ হয়ে ওঠার প্রমাণও হাতেনাতে ফলতে শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করার কাজটি নিয়ে যত সময়ক্ষেপণ হবে, মতানৈক্য থাকবে, তত বেশি মোকাবেলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি এড়ানোর পথ একটাই, সেটা হল শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোকে এক টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫৩
আপনার মতামত জানানঃ